নিজস্ব প্রতিবেদক
নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর হামলা
৫ মার্চ ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের শেষ ধাপে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেটসহ সারা দেশে নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে দেশকে রক্তে রঞ্জিত করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। গণহত্যার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। শহরে-বন্দরে, গ্রামগঞ্জে, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শাসকগোষ্ঠী এই আন্দোলন দমন করার জন্য সর্বত্র পশুশক্তির আশ্রয় নেয়। শুধু ঢাকা শহরেই শত শত মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। বর্বরোচিত পন্থায় নিরীহ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ইয়াহিয়া-ভুট্টো। এসব ঘটনায় পাকিস্তানি সেনাদের দোসর ছিল বিহারি বলে পরিচিত পাকিস্তানপন্থি বিহারিরা। ১৯৪৭ সালে ভারতের ভাগের পটভূমিতে তারা পূর্ববঙ্গে এসেছিল ভারতের বিহার প্রদেশ ও কলকাতা শহর থেকে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ৫ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র জনতাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমি তার তীব্র নিন্দা জানাই। অথচ আমরা জানি বিদেশি হামলা থেকে দেশকে রক্ষার জন্যই এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হওয়ার কথা।
পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাজউদ্দীন বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরও উচিত বাংলাদেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর গণহত্যা বন্ধের দাবি তোলা।
পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী গ্রুপ) সভাপতি মোজাফ্ফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন যুক্ত বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, ‘পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী দেশে গণতন্ত্র বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অস্বীকার করেছে। বাংলার জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি প্রভৃতি দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য নানা রকম হীন ষড়যন্ত্র ও যাবতীয় নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এরই প্রতিবাদে শহরে-বন্দরে, গ্রামগঞ্জে, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-জনতা, বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। শাসকগোষ্ঠী এই আন্দোলন দমন করার জন্য সর্বত্র পশুশক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেছে। শুধু ঢাকা শহরেই শত শত মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। তারা এ দেশে সর্বত্র একই বর্বরোচিত পন্থায় নিরীহ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এবং গণহত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। এ গণহত্যা চলতে থাকলে জনগণের পক্ষে পরিবেশ শান্ত রাখা সম্ভব হবে না। ফলে কোনো মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে শাসকগোষ্ঠীকেই দায়ী হতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) আয়োজিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জনসভায় মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগ্রামকে সার্থক করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে। সরকার যদি মনে করেন রক্ত নিয়ে বাঙালিকে দমন করা যাবে, তাহলে ভুল করেছেন। ঘটনা যাই ঘটুক, বাংলার বুকে স্বাধিকারের যে পতাকা আজ উড়ছে তা নামানো যাবে না।
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক বিবৃতিতে বলেন, এই স্বাধীকার সংগ্রাম, জনতার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। এখন যা দরকার তাহল ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বার গণ-আন্দোলন আরো জোরদার করা।
ন্যাপপ্রধান মওলানাা ভাসানী বলেন, দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে অনেক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে দেশ আজ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, এ মুহূর্তে দল-মত নির্বিশেষে সংকীর্ণতা ও নেতৃত্বের কোন্দল ভুলে স্বাধিকার সংগ্রামে কাতারবন্দি হওয়া প্রয়োজন। যেকোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে আমি ও আমার দল এক কাতারে সংগ্রাম করতে প্রস্তুত।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তিন আসামি স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, এস এম সুলতান উদ্দিন এবং এল এম নূর মোহাম্মদ এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলার স্বাধিকার আদায়ের চূড়ান্ত সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য দল-মত নির্বিশেষে বাঙালিদের প্রতি আবেদন জানান। তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র।