reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষতায় বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

প্রতীকী ছবি

দেশের হাসপাতালগুলোর বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করেছে। দু-চারটি হাসপাতালের কথা বাদ দিলে অধিকাংশ হাসপাতালের চিত্র প্রায় একই রকম। অদক্ষ ব্যবস্থাপনা নিয়েই বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর জীবন নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। একজন রোগী পেলে তার গলা কাটার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উঠেপড়ে লাগে। সেবা কতটুকু দিচ্ছে তার হিসাব নেই, কিন্তু রোগীকে জিম্মি করে যত রকম কায়দা-কানুন করে বিরাট অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই যেন প্রধান উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্য খাতের এ পরিস্থিতিতে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে প্রাণ যায় আরেক শিশু আয়হামের। এ তিন ঘটনাতেই অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি শিশুদের। এসব ঘটনার সব বেসরকারি হাসপাতালে। খতনা বা নাকের পলিপ অপারেশনের মতো ছোট সার্জারিতেও রোগীর মৃত্যু থামছেই না। এর আগের দিন সোমবার ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করতে গিয়ে ৩২ বছরের যুবকের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় রিপোর্ট না দেখে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার অভিযোগ করে পরিবার।

এছাড়া গত ৩১ ডিসেম্বর খতনার জন্য রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ানকে নিয়ে যান তার অভিভাবক। সকাল ৯টায় শিশুটিকে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়। তবে অনুমতি ছাড়াই ‘ফুল অ্যানেস্থেসিয়া’ (জেনারেল) দিয়ে চিকিৎসক আয়ানের খতনা করান বলে অভিযোগ করা হয়। পরে জ্ঞান না ফেরায় তাকে গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এরপর ৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে চিকিৎসক আয়ানকে মৃত ঘোষণা করেন। এরও আগে গত নভেম্বরে রাজধানীর নয়াবাজার এলাকায় মেডিপ্যাথ হাসপাতালে মেয়ে ফাতেমার (১২) নাকের পলিপ অপারেশন করাতে নিয়ে যান তার মা। কিন্তু পলিপ অপারেশন করতে গিয়ে মৃত্যু হয় ফাতেমার। ফাতেমার মায়ের অভিযোগ, মেয়েকে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যান। তার মেয়ে কোনো অসুস্থ রোগী ছিল না। ফাতেমা তার সঙ্গে হেঁটে হাসপাতালে যায়। ধারাবাহিক এসব ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি। দেশের পাঁচ তারকা হাসপাতাল, সাধারণ ক্লিনিক কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না অভিযোগের তালিকা থেকে। এটা অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা নাকি অবহেলা, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।

ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগে মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। গত বুধবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে মন্ত্রী বলেন, ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মঈনুল আহসানকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিচালক দ্রুত সময়ে জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উপস্থিত হয়ে হাসপাতালটির সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো জানান, এ ঘটনায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত। এরকম আর কারো কোনোরকম দায়িত্বে গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। দোষী প্রমাণ হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াসহ দায়িত্বে অবহেলাকারী দোষীদেরও কঠোর শাস্তি নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অন্যদিকে ল্যাবএইড হাসপাতালে আরেকটি মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও বিবৃতি দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ‘ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করাতে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পরিদর্শন করা হয়েছে। রিপোর্ট দেখে সে বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের দক্ষতার অভাব। এছাড়া অ্যানেস্থেসিয়ার আগে ঠিকমতো রোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করা এবং অপারেশন-পরবর্তী জটিলতা মোকাবিলার সক্ষমতা না থাকাও মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে আগামী রবিবার সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।

সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন মেডিসিনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. কাওছার সরদার বলেন, ‘কতটুটু ঝুঁকি আছে, সেটি নির্ণয়ের জন্য হার্ট, ফুসফুসসহ শরীরের অন্য অবস্থা কী, সেটি অ্যাসেস করেএকটি প্রি-অ্যানেস্থেটিক চেকআপ করাতে হয়। কিন্তু পেরিফেরাল যেসব ক্লিনিক আছে, সেগুলোয় এ হার শূন্য।’ ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব সোসাইটিস অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের মতে, প্রতি লাখ মানুষের জন্য অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট প্রয়োজন ৫ জন। কিন্তু দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছে ২ হাজারের কিছু বেশি, যা খুবই অপ্রতুল। তিনি আরো বলেন, প্রায়ই দেখা যায়, এসব অঘটন যেখানে ঘটে, সেখানে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট নন এরকম ফিজিশিয়ান বা তিনি কোনো চিকিৎসকও নন, তিনি অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে দিচ্ছেন। দেশে প্রতি বছর অ্যানেস্থেসিয়া জটিলতায় কত মৃত্যু হয় তারও কোনো হিসাব নেই কারো কাছে।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদণ্ডই-মহাবুব বলেন, ‘নামিদামি হাসপাতালে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের নিয়ে সমাজে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, রাষ্ট্র ও রেগুলেটরি বডি কেউ দায় এড়াতে পারে না। এগুলো কেন ঘটছে, চিকিৎসকের ভুল ও অবহেলা ছিল কি না, তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কতটুকু, সেগুলো দেখা দরকার। হাসপাতালগুলোকে নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার। তদন্ত হওয়া দরকার। তবে কোনো চিকিৎসকই চান না রোগী মারা যাক। বিভিন্ন দেশেই এমনটা হয়। এজন্য চিকিৎসক, অভিভাবক, সরকার, সংশ্লিষ্ট দপ্তর, গণমাধ্যম সবাইকে একসঙ্গে কাজের পরামর্শ দেন তিনি।’ চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়ে অভিযোগ করার একমাত্র সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। ২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসার অবহেলায় ২৮০টির মতো অভিযোগ জমা পড়েছে এখানে। এর মধ্যে মাত্র ৪০টির মতো নিষ্পত্তি করতে পেরেছে তারা।

চিকিৎসায় ভুল ও অবহেলা সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয় এভাবে রোগী মৃত্যুর বড় কারণ অদক্ষতা এবং জবাবদিহির অভাব। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর ব্যাপারে যতটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মনোযোগ প্রয়োজন তা নেই। নইলে এভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধ লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক গড়ে ওঠে কীভাবে। অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেই শুনি সে ক্লিনিকের লাইসেন্স নেই। তাহলে এতদিন প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছিল কীভাবে।’ তিনি আরো বলেন, দেশের বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় স্বাস্থ্য শিক্ষার মানও নিম্নগামী। এসব শিক্ষার্থী উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই চিকিৎসক হচ্ছে। টাকা খরচ করলেও মানুষ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। নইলে ইউনাইটেড, ল্যাবএইডের মতো করপোরেট হাসপাতালে কীভাবে এসব ঘটনা ঘটে। শুধু স্বাস্থ্য নয়, দেশের সব খাতেই বিশৃঙ্খলা, দায়সারা আচরণ চলছে।

এবার নোয়াখালীতে খতনায় ভুল, চিকিৎসককে বদলি

এদিকে নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে এক শিশুকে খতনা করানোর সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ডা. মাসুম বলেন, গত বুধবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি শিশুকে সুন্নতে খতনা করানোর সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সকালে জেলা সিভিল সার্জন অফিসের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। ঘটনার সত্যতা পেয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বিজয় কুমার দেকে তাৎক্ষণিক চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের নির্দেশে কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। বর্তমানে শিশুটি ভালো আছে বলেও জানান তিনি।

শিশুটির বাবা আলমগীর হোসেন বাদল জানান, ‘আমার ছেলে এখন ভালো আছে। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স সবাই এখন তার দেখভাল করছেন। তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।’ প্রসঙ্গত, আল নাহিয়ান তাজবীব (৭) নামে এক শিশুকে তার বাবা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে খতনা করতে নিয়ে যান। এ সময় কর্মরত উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা বিজয় কুমার দে ও চিকিৎসক সহকারী সৌরভ ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে খতনা করানোর সময় শিশুটির গোপনাঙ্গের চামড়া বেশি কেটে যায়। এতে অতিরিক্ত রক্তপাত শুরু হয়। পরে শিশুর চিৎকারে তার বাবা দেখেন রক্তপাতে কেবিনের বিছানা ভিজে গেছে। ঘটনা শুনে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ সেলিম দ্রুত জরুরি বিভাগে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

পিডিএস/এমএইউ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোম্পানীগঞ্জ,কমিউনিটি মেডিকেল,নোয়াখালী,মুসলমানি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close