নিজস্ব প্রতিবেদক
ভাষা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রতিবাদে সভা
আজ ৩ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে পূর্ব বঙ্গজুড়ে (বর্তমান বাংলাদেশ) ভাষা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রতিবাদে কমিটি অব অ্যাকশন ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ সভা ডাকে। তবে ১৯৪৭ সাল থেকেই বাঙালি ছাত্র ও নেতাদের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও দাওয়াতে বাংলা ভাষাকে সরকারি মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলা হয়। এভাবে বাংলা ভাষার দাবি পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এর সূচনা হলেও ক্রমেই এটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। দুই পর্বে বিভক্ত এ আন্দোলন ১৯৪৮ সালে অনেকটা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হলেও ১৯৫২ সালের আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। শুধু শিক্ষিত শ্রেণি নয় বরং পুরো বাঙালি জাতির মধ্যে এর প্রভাব পড়ে। এ পর্যায়ে শুধু ভাষার বৈষম্য নয়, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালির প্রতি বৈষম্য পরিস্ফূটিত করে। এর ফলে ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে একক রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে আসে এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন করে তোলে।
এভাবে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি, উদার দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা, সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে নতুন পরিমন্ডলে নিয়ে যায়। বাঙালি জাতির পরবর্তীকালে সংগঠিত প্রতিটি আন্দোলনে প্রেরণা আসে ভাষা আন্দোলন থেকে। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাই বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়। সুতরাং বলা যায়, ভাষা আন্দোলনের ফলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে, প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের মতো বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির জন্য একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজনীয়তা প্রথম থেকেই শাসকগোষ্ঠী অনুভব করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের বড় অংশ ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের উচ্চ পদবিধারীরা ছিলেন উর্দুভাষী মোহাজের। জিন্নাহ ও তার উত্তরসূরি লিয়াকত আলীর মন্ত্রিসভাকে তাই ‘মোহাজের মন্ত্রিসভা’ বলা হতো।
এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৪৭-৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের ২৭ জন গভর্নর জেনারেল/প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন মোহাজের। এদের আবার অধিকাংশের ভাষা ছিল উর্দু। যে কারণে প্রথমে থেকেই শ্রেণি স্বার্থে তারা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন। এমনকি নাজিমুদ্দিন যিনি পূর্ববাংলার উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন তিনি ছিলেন উর্দুভাষী। স্বভাবতই তারা ও পশ্চিম পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বত্র নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য এ ভাষাকে বেছে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বহু দিন থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে চর্চা করায় তারা উর্দুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ও প্রভাবশালী অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি হওয়ায় তারা সবাই এ ভাষার পক্ষে ছিলেন। তবে পূর্ব বাংলায় এর প্রতিবাদ ওঠে। কারণ পূর্ব বাংলায় কখনোই উর্দু চর্চা হয়নি। বাঙালিরা গণতন্ত্র, জনসংখ্যাধিক্য ইত্যাদি কারণে ৫৬ ভাগ বাংলাভাষীদের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করেছে। তথ্যসূত্র : ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ।
পিডিএস/এমএ