আব্দুর রহমান রাসেল, রংপুর প্রতিনিধি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামা
রংপুরে সব এমপির সম্পদ পাঁচ বছরে কয়েকগুণ
রংপুরের ছয়টি সংসদীয় আসনের সব সংসদ সদস্যের (এমপি) অর্থ ও সম্পদ গত পাঁচ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে কারো নগদ অর্থ বেড়েছে, কারো বেড়েছে ব্যাংকে জমা। কেউ কিনেছেন জমি, কেউ গড়েছেন অট্টালিকা। কারো কারো স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদও বেড়েছে কয়েকগুণ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জেলার ৬টি আসনে যথাক্রমে সংসদ সদস্যরা হলেন মসিউর রহমান রাঙ্গা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্শি, আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এদের মধ্যে তিন জায়গায় প্রার্থী রদবদল করেছে তাদের দল।
রংপুর-১ আসনে মসিউর রহমান রাঙ্গা এবার জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তার মনোনয়ন বৈধতা পেয়েছে। রংপুর-৩ আসনে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদপুত্র সাদ এরশাদকে বাদ দিয়ে এই আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এছাড়া রংপুর-৫ আসনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান নিজে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না নিলেও তার ছেলে রাশেক রহমান ওই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন।
রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত মহাসচিব ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গার নগদ অর্থের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ। একইসঙ্গে জমিসহ স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণও বেড়েছে এই রাজনীতিকের।
এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় রাঙ্গার নগদ টাকা ছিল ২৭ লাখ ৮ হাজার ৫৪৬ টাকা। পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২৪ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ টাকা। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর আগে টাকা জমা না থাকলেও এবার হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯৩ টাকা।
২০১৮ সালের হলফনামায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ছিল ৮৯ লাখ ৫৬ হাজার ৯৩৪ টাকা। এবারের হলফনামায় তা দেখানো হয়েছে ২ কোটি ১ লাখ ৪ হাজার ২১৫ টাকা।
পাঁচ বছরে বেড়েছে জমিসহ স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণও। ২০১৮ সালের হলফে জমির পরিমাণ ১২ একর ৩৩ শতাংশ দেখানো হয়েছিল। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ একর ৫৪ শতাংশে। পাঁচ বছর আগে কৃষি, অকৃষি জমি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, বাগান ও খামারের মূল্য এবং আয় ছিল ৩ কোটি ৬৪ লাখ ২০ হাজার ২৭৫ টাকা। এবার দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৬ টাকা।
২০১৮ সালে ব্যাংক ঋণ দেখানো হয় ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৫ টাকা। সবশেষ ২০২৩ সালের হলফ নামায় ব্যাংক ঋণ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৭ টাকা।
আয়ের উৎস হিসেবে দেখিয়েছেন কৃষি খাত, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা, চাকরিসহ শেয়ার ও সঞ্চয়পত্র।
টানা দুবার রংপুর-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় তার নগদ টাকার পরিমাণ না বাড়লেও বেড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা করা অর্থের পরিমাণ। একইসঙ্গে বেড়েছে পরিবহন খাতের ব্যয়ও।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ডিউকের নগদ টাকা ছিল ৫ লাখ এবারও নগদ টাকা একই পরিমাণ রয়েছে। ওই সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা করা অর্থ জমা না থাকলেও এবার নিজ নামে নগদ ৫৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬১ টাকা ও তার স্ত্রীর নামে ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ১১৩ টাকা জমা দেখিয়েছেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজ নামে পরিবহনের ব্যয় হিসেবে ৯০ লাখ টাকা দেখিয়েছেন যা একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছিল ৭০ হাজার টাকা।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ২০১৯ সালে মারা গেলে রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন তার ছেলে সাদ এরশাদ। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটি থেকে সাদ এরশাদকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টির হয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন চেয়ারম্যান জি এম কাদের। যাচাই-বাছাই শেষে তার মনোনয়ন বৈধতা পেয়েছে। এর আগে তিনি লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জি এম কাদেরের জমা দেওয়া হলফনামায় দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে তিনগুণের বেশি। একইসঙ্গে তার স্ত্রী শেরীফা কাদেরের সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জি এম কাদের নগদ ছিল ১৪ লাখ ৪৭ হাজার ৯৭৩ টাকা উল্লেখ করেছিলেন। পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৩ টাকায়। একই সঙ্গে শেরীফা কাদেরের নগদ ছিল ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭০১ টাকা, পাঁচ বছরে বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫৬৩ টাকা।
এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর আগে জমা ছিল ১৩ লাখ ২ হাজার ৪৩৫ টাকা। এবার হয়েছে ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯৩ টাকা। স্ত্রীর ছিল ৪ লাখ ৭২ হাজার ৫৮২ টাকা, তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ ৯ হাজার ৩৫৯ টাকা।
জি এম কাদের আগে চড়তেন ৪০ লাখ টাকা দামের প্রাডো গাড়িতে, এখন চড়েন ৮৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৫ টাকার জিপ গাড়িতে। পাঁচ বছর আগে স্ত্রী শেরীফা কাদের চড়তেন ১৫ লাখ টাকার গাড়িতে, এখন তিনি চড়েন ৮০ লাখ টাকার জিপে। নিজ ও স্ত্রীর নামে জমি, বাড়ি, স্বর্ণালঙ্কার বাড়েনি।
রংপুর-৪ আসনে ৩ বারের এমপি টিপু মুন্শির একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নগদ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থসহ সবই দেখিয়েছেন তার স্ত্রীর নামে। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজ নামে নগদ ২ কোটি ৯০ হাজার ২৩৬ টাকা, বন্ড, শেয়ার ও ঋণপত্রের ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ টাকাসহ সব সম্পত্তি দেখিয়েছেন নিজ নামে, স্ত্রীর নামে দেখাননি কিছুই।
তার আসনে বিদ্যুতায়ন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে শতভাগ আর স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগ উন্নয়নে অর্জন ৯০ শতাংশ উল্লেখ করেছেন হলফনামায়।
রংপুর-৫ আসনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান সরকারের টানা তিনবারসহ পাঁচবারের সংসদ সদস্য। তবে এবার তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নেননি। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করছেন তার ছেলে রাশেক রহমান। গত ৪ ডিসেম্বর যাচাই-বাছাই শেষে তার মনোনয়ন বৈধতা পেয়েছে।
রংপুর-৬ আসন থেকে টানা দুবার সংসদ সদস্য হয়েছে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় তার নগদ টাকার পরিমাণ কমলেও বেড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৭৭ লাখ ৯৩ হাজার ৭১১ টাকা আর এবারে জমা দেওয়া হলফনামায় এর পরিমাণ দেখিয়েছেন ১ কোটি ৫০ লাখ ৯৩ হাজার ২২ টাকা।
গেল পাঁচ বছরে তার আসনে শতভাগ বিদ্যুতায়ন, মহিলা উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন, অবকাঠামো উন্নয়নসহ শিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন বলে উল্লেখ করেন।
পিডিএস/এএমকে