বদরুল আলম মজুমদার
জ্যেষ্ঠ নেতাদের মুখেও এখন হিরো আলম
আশরাফুল আলম সাঈদ, যিনি হিরো আলম নামে অধিক পরিচিত। সামাজিক গণমাধ্যম নির্ভর একজন গায়ক বা মডেল থেকে আলোচনায় আসা হিরো আলম এখন রাজনীতিতেও বেশ আলোচিত। তিনি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি না হয়েও তিনি রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে হয়ে উঠেছেন আলোচিত চরিত্র। হিরো আলমের নাম জাতীয় নেতাদের মুখে মুখে ফিরছে।
সংসদের সর্বশেষ উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিরো আলম রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছেন। অনেকে নির্বাচনী রাজনীতিতে এটাকে হিরো আলম ঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধান দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলের নেতারা প্রতিপক্ষের ‘মান’ বোঝাতে হিরো আলমকে উদাহরণ হিসেবে টানছেন। দুই দলই মোটামুটি নিজেদের মতো করে হিরো আলমের একটা ‘মান’ ঠিক করে নিয়েছেন।
বিএনপির ছেড়ে দেওয়া বগুড়ার দুটি আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন হিরো আলম। এর মধ্যে একটি আসনে সামান্য ভোটে তিনি পরাজিত হন। তিনি পাস করতে পারলে কেমন সংসদ সদস্য হবেন এটি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। হিরো আলম নির্বাচনে জিততে পারবেন কি না এমন বিতর্কের মাঝে নির্বাচনী ফলাফলে রীতিমতো চমক দেখান হিরো। একটি সংসদীয় আসনে মাত্র ৮৫৪ ভোটে পরাজিত হন তিনি। এ ফল মানেননি হিরো আলম, তাকে স্যার বলতে হবে বলে শিক্ষিত কর্মকর্তারা তার রেজাল্ট পাল্টে দিয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। এমন অভিযোগের মুখে তার নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক জাতীয় পর্যায়ের নেতা। ফখরুলের বক্তব্য দেওয়ার ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে হিরো আলমের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দুই জাতীয় নেতার বক্তব্য দেওয়ার পর পরই নিজের ভেরিফাইড পেজে লাইভে কথা বলেন হিরো আলমও।
গত শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিধির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে হিরো আলম হিরো হয়েছে একটি মাত্র কারণে। সে প্রমাণ করেছে, এই আওয়ামী লীগ হিরো আলমের কাছেও কতটা অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তাদের টিকতে হয়। তিনি বলেন, যারা নির্বাচিত নয়, যারা বারবার বাংলাদেশের মানুষকে প্রতারিত করেছে, বোকা বানিয়ে ক্ষমতায় জোর করে টিকে থেকেছে, তাদের অধীনে কখনো কোনো নির্বাচন হতে পারে না।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন, জাতীয় সংসদকে খাটো করতে বিএনপি হিরো আলমকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করেছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে দলের এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘ফখরুল সাহেব বললেন, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে হিরো আলমকে হারানো হয়েছে। হায়রে মায়া! হিরো আলমের জন্য এত দরদ উঠল তার। তিনি ভেবেছিলেন, হিরো আলম জিতে যাবে। কিন্তু হিরো আলম এখন জিরো হয়ে গেছে। হিরো আলমকে বিএনপি নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে। তারা সংসদকে ছোট করার জন্য হিরো আলমকে প্রার্থী করেছে। অবশেষে ফখরুলের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।’
হিরো আলমকে নিয়ে জাতীয় নেতাদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের নির্বাচনব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল হিরো আলমের প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন, হিরো আলমকে দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এই সরকারের জনপ্রিয়তা কেমন। তার বক্তব্য, হিরো আলমকেও সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করেই হারাতে হচ্ছে। তার কথার জবাবে ওবায়দুল কাদের হিরো আলমকে বিএনপির প্রার্থী বানিয়ে দিয়েছেন। আমার মনে হয়, এটা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলছেন, বগুড়ার নির্বাচনের কারণে। আওয়ামী লীগ মনে করে বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি। বিএনপির ভোটগুলো হিরো আলমকেই দিয়েছে সবাই। বিভিন্ন কারণে হিরো আলম বেশ আলোচিত। বলতে গেলে কৌতুকের খোরাক। তাই রাজনীতির কঠিন কথাবার্তার ফাঁকে নেতারা মাঝে মাঝে রসবোধ জাতীয় কথা বলে থাকেন। হিরো আলম প্রসঙ্গও এমন হতে পারে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের বিষয়ে পরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে এসে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হিরো আলম। বিএনপির মহাসচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন সেই প্রসঙ্গ তুলে হিরো আলম বলেন, ‘মির্জা আলমগীর বলেন, এই সরকার এখন অসহায় হয়ে গেছে। এই সরকার অসহায় হয়েছে কি না, আমি জানি না। তবে আমি হিরো আলম যে অসহায় হয়েছি এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?’
অন্যদিকে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের বিষয়ে হিরো আলম বলেন, ‘আমি পার্লামেন্টে গেলে পার্লামেন্টকে যদি ছোট করা হয়, তবে যখন মনোনয়ন কিনছি, তখন কিন্তু আপনাদের বলা উচিত ছিল, হিরো আলমের কাছে যেন মনোনয়ন বিক্রি করা না হয়। আপনারাই বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশ, সবাই নির্বাচন করতে পারবে। সবার যদি নির্বাচন করার কথা আইনে থাকে, তাহলে আমি ভোটে দাঁড়ালে সংসদ ছোট হবে কেন? তাহলে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে আইন করতে হবে?’
হিরো আলম গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘রজনীকান্ত, হিরো আলম ও মানুষের মন’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন নৃবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দীন। সেই কলামে তিনি হিরো আলমকে ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অবিস্মরণীয় বাঁক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এর ব্যাখ্যায় কলামের একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘মধ্যবিত্ত যা বলতে পারছে না, হিরো আলম অকপটেই বলেছেন।’ যেমন ‘আমার মতো সামান্য একজন মানুষকেও সরকার ভয় পায়’, কিংবা ‘ভোটই দিতে দেয়নি, জামানত ফেরত দেবে না কেন’।
হিরো আলম মনে করেছেন, ভোট জালিয়াতি করে তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার বিজয় ছিনতাই করা হয়েছে। এজন্য তিনি প্রতিকার চেয়েছেন। তার সঙ্গে কেন এমন ঘটতে পারে, সেটিও নিজের বিবেচনামতো স্পষ্ট করেই বলেছেন ১ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফল ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যারা আমাকে মেনে নিতে চান না। তারা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে স্যার বলে ডাকতে হবে। এজন্য তারা আমাকে মানতে চান না। তারা আমার বিজয় মেনে নিতে পারেননি। নির্বাচন নিয়ে এ রকম প্রহসন হলে, কারচুপি হলে মানুষ নির্বাচন ভুলে যাবে।’
পিডিএসও/এমএ