রাহাত চৌধুরী, জাবি
সাবেক শিক্ষার্থীরা হলে সিট দখল করে আছেন, নতুনরা সুযোগ বঞ্চিত
অবশেষে অনলাইনে ক্লাস, শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ
অছাত্রদের হল থেকে পুরোপুরি বের করতে ব্যর্থ প্রশাসন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথমবর্ষের ক্লাস শুরু হচ্ছে আগামী কাল বৃহস্পতিবার। আবাসন সংকটের কারণে এবার অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম বা পাঠ দান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভর্তি পরীক্ষার প্রায় পাঁচ মাস পর অনলাইনে ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।
গত ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান কমিটির সদস্য সচিব ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার সৈয়দ মোহাম্মদ আলী রেজা। নতুন হলগুলোতে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ায় সেগুলা চালু করা সম্ভব না হওয়ায় সাময়িকভাবে অনলাইনে ক্লাস শুরু হচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা গত ১৮ জুন শুরু হয়ে ২২ জুন শেষ হয়। আর ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয় ১৮ সেপ্টেম্বর। সে হিসেবে পাঁচ মাস পর শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। অথচ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সশরীরে ক্লাস শুরু হয়েছে অনেক আগেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম পর্যালোচনা করে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৬ আগস্ট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ সেপ্টেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ অক্টোবর থেকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এ শিক্ষাবর্ষ ছাড়াও বিগত বছরগুলোতেও একই চিত্র দেখা যায়। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়। অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে একই শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এছাড়া মহামারীর কারণে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সমসাময়িক সময়ে (২০২১ সালের ডিসেম্বর-২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি) সশরীরে ক্লাস শুরু হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মাস পর ২০২২ সালের ৯ মার্চ অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। পরে ২৩ মে থেকে সশরীরে ক্লাস শুরু হয়। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ২১ জানুয়ারি থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়। অথচ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয় সে বছরের ১০ মার্চ।
অনলাইনে ক্লাস শুরু করায় সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ভর্তি হওয়া তানজীন মুনা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা পদ্ধতি উচ্চ মাধ্যমিকের চেয়ে আলাদা। সে হিসেবে শুরুতেই অনলাইন ক্লাসে লেকচার ভালোভাবে আয়ত্ত করা অনিশ্চিত। শুরুতেই যদি ঘাটতি থেকে যায়, তাহলে তা পুরো বছরই পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।
সবার শেষে ক্লাস শুরু করে তা আবার অনলাইনে নেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন অভিভাবকরাও। প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়া এক নবীন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে যারা অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তারা ইতোমধ্যে এক দেড় মাস যাবত ক্লাস করছে। ফলে শুরুতেই সে পিছিয়ে পড়লো। এতে তার পড়াশোনার স্বাভাবিক গতি নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া শুরুতেই অনলাাইনে ক্লাস শুরু করায় তার পড়াশোনার প্রতি অনীহা চলে আসতে পারে। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন অতি সত্ত্বর সশরীরে ক্লাস শুরুর ব্যবস্থা করা উচিত।
এদিকে অনলাইনে ক্লাস শুরু করায় প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা। গত ২৪ নভেম্বর নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে অনলাইনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে দ্রুত হলগুলো খুলে দিয়ে সরাসরি ক্লাস শুরুর দাবি জানান। এদিকে উল্টো চিত্র দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল গুলোতে। যেখানে আবাসন সংকটের কারণে সশরীরে শ্রেণী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না নবীন শিক্ষার্থীরা, সেখানে পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলেও দেদারসে হলে থাকছেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, ফার্মেসি বিভাগ বাদে বিশ^বিদ্যালয়ের ৪৫ ব্যাচ (২০১৫-১৬ সেশন) পর্যন্ত সব বিভাগেই মাস্টার্স শেষ হয়েছে। ৪৬ ব্যাচেরও (২০১৬-১৭ সেশন) বেশিরভাগ বিভাগে মাস্টার্স শেষ হয়েছে এবং কয়েকটি বিভাগে পরীক্ষা চলমান আছে। তবে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হলে অবস্থান করছেন ৪৪ ব্যাচ (২০১৪-১৫ সেশন) ও ৪৫ ব্যাচের (২০১৫-১৬ সেশন) অধিকাংশ শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮-এর ৫(ট) ধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা সমাপ্তির সাত দিনের মধ্যে তাদের পরিচয়পত্র, চিকিৎসা ও গ্রন্থাগার কার্ড ফেরত দিয়ে নিজ নিজ আবাসিক হল ত্যাগ করবে। একই ধারায় এ বিধি অমান্য করার শাস্তি উল্লেখ আছে, ‘যারা এ বিধি অমান্য করবে তাদের ফল প্রকাশ স্থগিত থাকবে।’
বিশ^বিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন , সশরীরে নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করতে না পারা পুরোপুরি প্রশাসনের ব্যর্থতা। আমরা দেখেছি অনলাইনে শ্রেণী কার্যক্রমে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, শিক্ষার্থীদের অনেকেই সে সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে না। ফলে নবীন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরতেই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। প্রশাসন অযুহাত দেখাচ্ছে নবীন শিক্ষার্থীদের যেন গণরুমে উঠতে না হয় সেজন্য শুরুতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু গণরুম সংস্কৃতির পিছনে মূল যে কারণ দায়ী, সাবেক শিক্ষার্থীদের হলে থাকা তা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অছাত্রদের হল থেকে পুরোপুরি বের করতে ব্যর্থ প্রশাসন। তাছাড়া নতুন হল চালু করতে যে জনবল সংকটের অযুহাত দেখাচ্ছে প্রশাসন তার নেপথ্যে যে নিয়োগ বাণিজ্য রয়েছে তা কারো অজানা নয়। প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়কে দিন দিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে।
প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নিগার সুলতানা এ ব্যাপারে বলেন, ৪৬ ব্যাচ পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার ব্যাপারে আমাদের প্রক্রিয়া চলমান। হল প্রশাসন এটা নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা যারা গণরুমে রয়েছে তাদের সিটে তোলার ব্যবস্থা করছি আগে। নতুন দুটি হলে লোকবল নিয়োগ হয়ে গেছে। বাকি চারটি হলেও নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান। নবীন শিক্ষার্থীদের হলে তোলার বিষয়ে আমরা আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা এ বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম তুলে দিতে চাই। নতুন হলগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের টেন্ডারের সব ফরমালিটিজ এ মাসের মধ্যে শেষ হবে। ডিসেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই আমরা শিক্ষার্থীদের হলে উঠতে পারব। অনলাইনে এ সময় সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ক্লাস চললেও কোনো পরীক্ষা হবে না।