জুবায়ের জামিল, রাবি

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

রাবির কেন্দ্রীয় গবেষণাগার ৩২ যন্ত্রের ২৪টিই অকেজো

ছবি : সংগৃহীত

গবেষণার কাজে ব্যবহৃত কোটি টাকা মূল্যের প্রযুক্তি-যন্ত্র দিয়ে সাজানো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। তবে সাজানো-গোছানো এ গবেষণাগারটির দুরবস্থা খালি চোখে দেখলে বুঝা মুশকিল। ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৩২টি যন্ত্র রয়েছে এই গবেষণাগারটিতে। এসব যন্ত্রপাতির প্রতিটির মূল্য ৪০ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকার কাছাকাছিও রয়েছে। তবে এগুলোর ২৪টি অকেজো।

এই ৩২টি যন্ত্রপাতির মধ্যে কার্যক্ষমতা রয়েছে মাত্র ৮টির। আর বাকিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। দুরবস্থার পরিধি শুধু এখানেই শেষ নয়! দক্ষ জনবলের অভাবে কার্যকর ৮টি যন্ত্র থেকে পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ফলে চরম ভোগান্তির মধ্য দিয়েই কোনোমতে কাজ করতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা যায়, মোট ১২টি অনুষদ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে ৭টিই হলো বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য। এই সাতটি অনুষদের অধীন রয়েছে ২৯টি বিভাগ। এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরাই মূলত গবেষণার প্রয়োজনে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয় ‘এফটিআইআর’ মেশিন যা বছর না পেরুতে নষ্ট হয়ে হয়ে যায়। ঠিক এমনি আরো চারটি যন্ত্র ২০০৪ সালে কেনা হলেও তা নষ্ট হয়ে আছে বছরের পর বছর।

এছাড়াও ২০১১ সালে ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয় ‘অটোমেটিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ’ এবং ২০১৩ সালে ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয় ‘এনার্জি ডিস্পেরসিভ এক্সরে ফ্লুরোসেন্স’ মেশিন। দুটি যন্ত্রই ৩ বছর না পার হতেই ২০১৬ সালে নষ্ট হয়ে যায়। কোটি টাকার ৮টি যন্ত্রসহ আরো ১৪টি যন্ত্র এভাবেই অকার্যকরভাবে পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যেমন কেন্দ্রীয় গবেষণাগার থাকার প্রয়োজন ছিল তেমন কোনো গবেষণাগার নেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে গবেষণাগারটি রয়েছে সেখানেও নেই প্রয়োজনীয় কোনো যন্ত্রপাতি। যেগুলো রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই অকার্যকর। ৩২টি মেশিনের মধ্যে ২৪টি যন্ত্র অকেজো। এতো অকেজো যন্ত্রপাতি থাকলে গবেষণাগারের আর কি থাকে? তারা বলছেন, প্রতিটা মেশিনের জন্য একজন করে ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার কিন্তু সেই পরিমাণ জনবল না থাকার কারণে কার্যকর যন্ত্রগুলোর সুবিধাও পাচ্ছেন না তারা। এছাড়াও পরিচিত শিক্ষকরা এসে সেখানে অগ্রাধিকার পায়। অফিস টাইম পার হয়ে গেলেই বন্ধ করে দেওয়া হয় গবেষণারটি। যার ফলে সময়মতো পাওয়া যায় না গবেষণার ফলাফল।

এদিকে, সচল আটটি যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে, অটোমেটিক অ্যাবসরপশন স্পেক্ট্রোস্কোপ (এএএস) মেশিন, এফটিআইআর মেশিন, ইনভার্টেড সিস্টেম মাইক্রোস্কোপ, টিজিআর, হট স্টেজ পোলারাইজড মাইক্রোস্কোপ, ইউভি ফিজিবল স্পেকট্রোফটোমিটার, সেন্ট্রিফিউজ উইথ আল্টা কুলিং এবং সিও২ ইনকিউবেটর।

এই নামমাত্র কয়েকটি সচল যন্ত্রপাতি দিয়ে কোনোভাবে চলছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। এমন অচলবস্থার দ্রুত সংস্কার চান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। তিনি বলেন, যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণাগার খুব বেশি সচল নয়। এখানকার অনেক যন্ত্রপাতি এখন নষ্ট প্রায়। যার ফলে খুব বেশি গবেষণার কাজ এখানে করা সম্ভব হয় না। আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে হয়, সেখানে এ ধরনের গবেষণাগারে সঠিকভাবে কাজ সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটার অতিদ্রুত সংস্করণ দরকার বলে মনে করেন তিনি।

তবে জনশক্তির সংকট এবং কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে অনুদানের অভাবকে দুষছেন গবেষণাগারটির পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, প্রতিটি মেশিনের জন্য একজন করে ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার কিন্তু আমাদের সে পরিমাণ জনবল নেই। তারপরও আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা করে যান ছাত্রদের সহযোগিতা করতে। পাশাপাশি আমাদের যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি রয়েছে তা যথেষ্ট না। যার ফলে অনেক গবেষণার কাজ করতে শিক্ষার্থীদের ঢাকা যেতে হচ্ছে।

এছাড়া তিনি বলেন, আমাদের গবেষণা অনুদান খুব বেশি না থাকায় একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার যেমনটা হওয়া দরকার তা হচ্ছে না।

জানা যায়, ২০২১ সালে সেপ্টেম্বরে মোট ১৯০৮ এবং ২০২২ সালে মোট ১৯৪৮টি গবেষণার স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থী গবেষণার কাজ করতে এলে সেম্পল প্রতি দিতে হয় ৫০ টাকা। অনেক সময় কোনো শিক্ষার্থীর ইমারজেন্সি কোন সেম্পলের ফলাফল পেতে গুনতে হয় ২০০ টাকা।

শুধু তাই নয়, এই সেম্পল টেস্ট করাতে এসেও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। পরিচিত ও প্রভাবশালী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের কাজ আগে করিয়ে নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অফিসের সময়ের পর বন্ধ হয়ে যায় গবেষণাগার। অর্থাৎ সকাল ৯ থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি।

এ বিষয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক কুদরত-ই-জাহান বলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার সবসময় খোলা থাকা দরকার। সেখানে দেখভাল করার মানুষ থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থাকলেও সেখানে নেই সংরক্ষণের মানুষ। আবার গবেষণাগার অফিস সময়ে চলে যার ফলে আমাদের খুব বেশি কাজ হয় না। একটা স্যাম্পলের রিপোর্ট পেতে গেলে সময় চলে যায় অনেক। একটি শিক্ষার্থীর একের অধিক স্যাম্পল থাকে যার ফলে তখন বিপাকে পড়তে হয়।

তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এই অভিযোগ স্বীকার করে পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, অফিস সময়ে গবেষণাগার খোলা থাকলেও আমরা মাঝে মাঝে এই সময়ের বাইরেও কাজ করে থাকি। এছাড়াও অনেক সময় পরিচিত শিক্ষকরা এসে তাদের কাজটা আগে করে দেওয়ার জন্য বলেন- সেখানে অনেক সময় না করা সম্ভব হয় না। তবে এই বিষয়ে যদি শিক্ষকরা আমাকে সহযোগিতা করে তাহলে আমি স্বচ্ছ থাকতে পারব বলেও জানান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারের এমন অচল অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের দাবি জানিয়ে রাবি সায়েন্স ক্লাবের সভাপতি আবিদ হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কেন্দ্রীয় গবেষণাগার এভাবে চলতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে মানসম্মত গবেষণা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব, যা শুধু আমাদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না বরং গোটা জাতিতে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গবেষণা কার্যক্রমকে আরো বেশী গতিশীল করতে গবেষকদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করা এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ করা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাবি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close