নাজমুল হুদা খান, কুয়েত প্রবাসী

  ১৪ মার্চ, ২০২৩

কুয়েত কথন (পর্ব ৪) : কুয়েতে নারীদের অগ্রগতি

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

গত ৮ই মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন। বর্তমান বিশ্বে আমাদের জীবনযাত্রার প্রতি পদে প্রযুক্তির শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে প্রিয়জনকে কল করা, ব্যাংক লেনদেন, মেডিক্যাল এপয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিরই অংশ। অথচ এখনো বিশ্বের প্রায় ৪০ ভাগ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না কিংবা করতে জানেন না। জাতিসংঘ বলছে, ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে আজকের বিশ্বে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, হিসাব ও গণিতসহ সকল পেশার ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চাকরি প্রযুক্তি নির্ভর থাকবে। এ প্রযুক্তিতে নারীরা পিছিয়ে থাকলে নারীদের সক্ষমতা অর্জন ও লিংঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায়ও পিছিয়ে থাকবে।

অন্যান্য দেশের মত কুয়েতেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষ্যে কুয়েতস্থ জাতিসংঘ হাউজের উদ্যোগে কুয়েত Women Economic Empowerment Platform (WEEP), UNDP এবং কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের Department of Women Studies বিভাগের অংশগ্রহণে নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ক সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন ও গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল বক্তা হিসেবে দেশটির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিষয়ক সুপ্রিম কাউন্সিলের সেক্রেটারী জেনারেল কুয়েতের নারীদের সক্ষমতা ও অগ্রগতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন।

গত সতের থেকে উনিশ শতাব্দী অবধি কুয়েতে তেল উৎপাদন শুরুর পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলে সামুদ্রিক বাণিজ্য ও মৎস আহরণই ছিল মূল পেশা। নারীরা মূলত গৃহস্থালির কার্যক্রম, সংসারের বিভিন্ন সামগ্রীর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিবারের সদস্যদের লালন পালনের কাজেই নিয়োজিত থাকতেন। শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অনেকটাই অনগ্রসর। উনিশ শতকের শুরু থেকে, মূলত ১৯৪০ সালের পর কুয়েতের নারীদের শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ বিস্তৃত হয় এবং তাদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হতে থাকে। পাশাপাশি নারীরা বহু সামাজিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসেন। গঠিত হয় আরব নারী রেনেঁসা এসোসিয়েশন, মহিলা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সোসাইটি, গার্লস স্পোর্টস ক্লাব। ২০০৫ সালে এদেশের নারীরা পূর্ণাঙ্গ ভোটাধিকার লাভ করেন এবং পরবর্তী বছর জাতীয় সংসদে ৫০ আসনে চার জন নারী সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। তন্মধ্যে একজন মন্ত্রিসভায় স্থান লাভ করেন।বর্তমান মন্ত্রীসভায় এ সংখ্যা তিনে উন্নীত হয়েছে। ২০২০ সালে কুয়েতের ইতিহাসে ৮ জন নারী জাজ হিসেবে শপথ নেন। এছড়া অনেক প্রতিষ্ঠানেই নীতিনির্ধারণী পদে নারীর দক্ষতার ছাপ রাখছেন। আরব দেশসমূহের মধ্যে কুয়েতেই প্রথম যেখানে কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ভাইস চ্যান্সেলর (প্রেসিডেন্ট) এবং কুয়েতের প্রথম সারির সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন।

দেশের স্বাধীনতা ও বিভিন্ন দূর্যোগ মোকাবেলায়ও নারীদের ভূমিকা অত্যুজ্জ্বল। ইরাকী আগ্রাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে অনন্য সাহসী ভূমিকা রেখেছেন অনেক নারী। কুয়েতের নাগরিকদের নিরাপদ করা এবং ইরাকী বাহিনীর তথ্য সংগ্রহ, প্রযুক্তি ধ্বংসে দু:সাহসী ভূমিকার জন্য ইরাকী বাহিনীর নির্মমতায় প্রাণ দিয়ে ইতিহাস হয়ে আছেন নারী সাহসের প্রতীক আসরার আল কাবান্দি। নোরিয়া আল সাদদানী একজন ইতিহাসবিদ ও সম্প্রচারক, যিনি ১৯৯১ সালের আগ্রাসনকালে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সাহসী ভূমিকা রাখেন ও স্বাধীনতার পর নারী যোদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। কুয়েতে নারী রেনেঁসার আরেক দিকপাল লোলওয়া এশা আল খাত্তামী। তিনি দেশের প্রথম নারী, যিনি বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং নারী জাগরণে অগ্রণী ভুমিকা রাখেন। আরেক বীর নারী সাবাহ আকবর। তিনি দেশের প্রথম পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার; ইরাকী আগ্রাসনে দেশের পেট্রোলিয়াম যন্ত্রপাতি রক্ষায় তার টিমকে সুকৌশলে কাজে লাগান এবং কুয়েতের ফায়ার ফাইটার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কুয়েতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী স্বাস্হ্য সেবা, মানবিক সাহায্য, সামাজিক সচেতনতা ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসেন।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশসমূহে যেখানে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা একুশ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে কুয়েতে এ হার শতকরা ৬০ ভাগ। নিউ কুয়েত ২০৩৫ রূপকল্পের ৭টি স্তম্ভ যথা: প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্ব্যসেবা, অবকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতিটিতে নারীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। এ রূপকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধ শত কোম্পানি নারীর ক্ষমতায়ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ন্যাশনাল ব্যাংক অফ কুয়েতের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নারী নীতিনির্ধারনীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত রয়েছেন।

ডিজিটাল ও কারিগরি প্রযুক্তির উন্নয়নে কুয়েত প্রশংসনীয় দক্ষতার ছাপ রেখেছে। শত ভাগ মানুষের কাছে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া, মাথাপিছু প্রায় ২টি মোবাইল সংযোগ, ডিজিটাল ইকোসিস্টেম এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনে কুয়েতি নারীরা সমান পদক্ষেপে এগিয়ে আসছেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কুয়েত,নারী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close