এন কে বি নয়ন, ফরিদপুর
১৬ বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে হতাশায় ফরিদপুরের বিজিবি সদস্য শওকত

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার বাসিন্দা ও সাবেক বিডিআরের একজন সদস্য শওকত আলী (৪২)। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ ১৬ বছর পর জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছেন। জামিনে মুক্ত হয়ে চোখে মুখে অন্ধকার আর হতাশার ছাপ সাবেক বিজিবি সদস্য শওকত আলীর। জেল জীবনে মায়ের মৃত্যুতেও জানাজায় অংশগ্রহণের অনুমতি পাননি।
খরব নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৬ বছর কারাভোগের পর নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেননি বিডিয়ার বিদ্রোহ মামলায় জামিন পাওয়া সাবেক বিজিবি সদস্য শওকত আলী। তার কেবলমাত্র ভিটেটুকু ছাড়া নেই কোন ঘর-বাড়ি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন ভাড়া বাড়িতে। মা হারানোর বেদনা নিয়ে মুক্তির পর এখন চাকরি পুনর্বহালের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন শওকত আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
পরিবার সুত্র জানায়, সাবেক বিডিআর বর্তমান (বর্ডার গার্ডের) সদস্য শওকত আলীর বাড়ি উপজেলার চতুল ইউনিয়নের বাইখীর-বনচাকী গ্রামে। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধ আজিজুর রহমান সিকদার মারা গেছেন ২০০৬ সালে। ৬ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। ২০০৫ সালে তিনি ঢাকা পিলখানায় ৪৪ রাইফেল ব্যাটেলিয়ান বিডিআরে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বিডিআর ব্যাটালিয়নের বিজিবি সদস্য হিসেবে পিলখানায় যোগদান করেন শওকত আলী। এরপর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছর ১৬ জুন তিনি গ্রেফতার হন। তখন মাত্র আড়াই বছরের এক ছেলে ও স্ত্রীকে রেখে কারাবন্দী হতে হন তিনি। গত ২৩ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৬ বছর পর বোয়ালমারীতে ভাড়া বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। তবে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ছেলের শোকে ২০১৬ সালে মারা যান তার মা হাজেরা বেগম (৬২)।
দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কারাগারে থাকায় ছেলের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণসহ পরিবারের হাল ধরেন শওকত আলীর সহধর্মিণী মনিরা পারভিন(৩৬)। একদিকে স্বামীর মামলা পরিচালনার খরচ, অপরদিকে ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে অমানবিক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। বুঝে ওঠার আগে বাবা দূরে আছেন জানিয়ে বুকে কষ্ট চেপে বড় করতে হয়েছে ছেলে নিশাতকে। অর্থের অভাবে দিনের পর দিন তিনবেলা ঠিকভাবে খাবার যোগাতেও হিমসিম খেতে হয়েছে মনিরা পারভিনকে। তিনি দর্জির কাজ করে কোনমতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আত্মীয়-স্বজনরা কোনরকম সাহায্য-সহযোগীতাও করেননি।
সরেজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘ এতো বছর পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফেরার আনন্দের চেয়ে হতাশা বেশী। দীর্ঘ ১৬ বছর পর স্ত্রী সন্তানকে কাছে পেয়ে আনন্দের অশ্রুও ঝরছে শওকতের। স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে আছেন। পৈতৃক সূত্রে কেবলমাত্র ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই নেই তার ফলে পরিপূর্ণ আনন্দ নেই শওকতের।
শওকত আলীর ছেলে নিশাত সিকদার ফাহিম (১৮) বলেন, বুঝতে শেখার পরে জেনেছি বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বাবা কারাগারে আছেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার সেই আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। দীর্ঘ বছর বাবাকে ছাড়া আমাদের পথ চলটা খুবই কষ্টের ছিল। খেয়ে না খেয়ে মা একা আমাকে মানুষ করেছেন।
শওকত আলীর স্ত্রী মনিরা পারভিন বলেন, আমার স্বামী বিনাদোষে জেলে যাওয়ার পর থেকেই আমাদের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। অনেক সময় ছেলের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারা মায়ের বেঁচে থাকা আর না থাকা সমান কথা। এখনও অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। সরকারের কাছে আমার স্বামীর পূনরায় চাকরি ফেরত এবং ক্ষতিপূরণসহ বেতন ভাতা পরিশোধ করার দাবি জানাই।
শওকত আলী বলেন, আমি কোন অপরাধ করিনি। অন্যায়ভাবে ১৬ টি বছর আমার জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমার কোন বাড়ি-ঘর নেই। বাবার কালের সামান্য একটু ভিটে আছে। তাও সেখানে যাওয়ার রাস্তা নেই। জেলের মধ্যে অসুস্থ অবস্থায় ২০১৬ ও ২০২২ সালে মেরুদণ্ডের হাড়ে দুইবার অপারেশন করতে হয়েছে। আমার শোকে মা মারা গেছেন কিন্তু তার মৃত্যুর মায়ের মুখ দেখতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন,জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে এখন মনে হচ্ছে জেলখানাতেই ভালো ছিলাম। অন্তত চোখের সামনে পরিবারের এমন করুন দশা দেখতে হতো না। স্ত্রী,ছেলেকে নিয়ে কোথায় কিভাবে থাকবো? সংসার চালাবো কিভাবে? আমি আমার স্ত্রী ও ছেলের ওপর বোঝা হয়ে গেছি। আমার চাকরি ফিরে পাওয়া সহ ক্ষতিপূরণ চাই।
এ বিষয়ে চতুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, শওকত আলী একজন সাবেক বিডিআর সদস্য। দীর্ঘদিন তিনি কারাগারে ছিলেন। জামিনে মুক্ত হয়ে এসে তিনি বোয়ালমারীতে একটি ভাড়া বাড়িতে আছেন। জানামতে তার পৈত্রিক ভিটে ছাড়া ঘর-বাড়ি কিছুই নেই।
উল্লেখ্য, এর আগে বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুর থেকে ১৬ বছর জেল খাটার পর ১৭৭ জন সাবেক বিডিআরের সদস্য কারামুক্ত হয়েছেন।
পিডিএস/এমএইউ