এম এ মাসুদ, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা)
পিংকি-তিথির বনভোজনে ফিরে এলো দুরন্ত শৈশব
বেশি দিন আগের কথা নয়। গ্রামের অনেকের বাড়িতেই ছিল হাঁস ও মুরগির ডিম। বাড়ির পাশে আমনের মাঠ ফাঁকা হলেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে মায়েদের নিকট একটি ডিম ও চালের বায়না ধরতো শিশুরা। সেই ডিম ও চাল সংগ্রহ করে ওই ফাঁকা মাঠে পাড়ার শিশুরা করতো বনভোজন। ডিম ও আলুর ডাল দিয়ে খেয়ে তাতেই ছিল শিশুরা খুশি। তারপর চুলা ভেঙে দিয়ে বাড়ি। তবে এখন আর তেমনটি দেখা না গেলেও এমন বনভোজনে শিশুরা মেতে উঠেছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের কোলঘেঁষা গ্রাম মীরগঞ্জে।
পিংকি ও তিথি বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল, ডিম, আলু ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করে কার্তিকের শেষ বিকেলে চড়িয়েছে রান্না। কেউ বা রাঁধছে ভাত, আবার কেউ বা সিদ্ধ করছে ডিম ও আলু। সাথে আছে তিশা, বিথিসহ আরও কয়েকজন। তারা এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে আনছে খড়ি ও খড়। পুবালি বাতাসে নিবু নিবু করছে ওদের চুলো। ধোঁয়ায় চোখ কচলাতে থাকে ওরা। তবুও চোখে-মুখে ওদের আনন্দের ঝিলিক।
কী করছো পিংকি বলতেই তারা সমশ্বরে জবাব দিল বনভোজন করছি। ডিম ও আলুর ডাল দিয়ে। এগুলো দিয়ে কী বনভোজন হয়? হেসে জবাব দিল, তাতেই আমরা খুশি।
বুঝতে আর বাকি রইলো না ওদের কথা। এটাই তো ওদের শৈশব, এটাই তো কৈশোর।
ভেসে ওঠে, চমৎকার ছিল শৈশবের সেই দিনগুলি স্মৃতি। কানামাছি, লুকোচুরি, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, ঘুড়ি ওড়ানো, পুতুলের বিয়ে, মোরগ যুদ্ধ, কত রকম খেলাই না খেলত গ্রামাঞ্চলে শিশুরা।
লটকন, ডুমুর ও পানিফলের মতো বুনোফল পাড়তে ঘুরে বেড়াত বনবাদারে। রঙে রঙিন মাকাল ফল নিয়ে ঘরে ফিরলে জুটতো মায়ের বকুনি। কিন্তু মায়ের বকুনিও থামাতে পারতো না ওদের দুরন্তপনাকে।
বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় ও পুকুর পাড়ে রাতের আঁধারে জ্বলতো হাজারো জোনাকি পোকা। সেই জোনাকি ধরতে মেতে উঠতো শিশুরা। আর বলতো, 'জোনাকি রে জোনাকি, ঘুটঘুটে আঁধারে, বনে আর বাদাড়ে, আলো জ্বেলে লাভ কী, খুঁজে পাস সোনা কী?'
আবার, সন্ধ্যে হলে দেখা যেত বাড়ির আঙিনার চুলোয় মায়েদের রান্না করতে। চুলো আর কিরোসিনের বাতির সেই আলোয় নাতি, নাতনিদের নিয়ে দাদিরা বসতেন পাটি বিছিয়ে। শোনাতেন জ্বীন, পরী, দেও, দৈত্যসহ ডালিম কুমার ও কঙ্কাবতীর সেই রুপকথার গল্প।
আর শিশুরা মনোযোগ দিয়ে শুনতো দাদির বলা সেই গল্প৷ গল্পের মাঝে একটুখানি বিরতি দিলেই শিশুরা বলতো, তারপর, তারপর? কাল্পনিক হলেও সে সব গল্প জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিত ওদের। গল্পের সাথে কল্পনা করে নিত ওরা জ্বীন, পরী, দেও এবং দৈত্যের আকার ও আকৃতি। ফলে বাড়তো তাদের কল্পনা শক্তি। শিশুর মানসিক বিকাশে যার অবদান ছিল অনন্য।
কিন্তু শিশুদের জীবন থেকে আজ হারিয়ে গেছে দুরন্তপনায় মেতে ওঠা সেই শৈশব ও কৈশোর। তার বদলে স্থান পেয়েছে কার্টুন ও ভিডিও গেম। খেলার সাথীদের থেকে দূরে রাখতে ওদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে মোবাইলের পাশাপাশি নানা ধরনের ইলেকট্রনিক খেলনা। সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে মিশে পড়াশোনা নষ্ট হবে এবং ধূলি ও কাদায় মাখামাখি করবে এমনটি আর পছন্দ নয় আধুনিক মায়েদের। তাই তো চারদেয়ালের মধ্যে বন্দি থেকে বারান্দায় খেলছে শিশুরা ওই সব খেলনা ও মোবাইল দিয়ে। এমন অসুস্থ বিনোদনে শিশুরা হারাচ্ছে তাদের শৈশব ও কৈশোরের মধুর দিনগুলো থেকে। ক্ষতিকর জেনেও আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিক। ফলে প্রকৃতির সাথে পরিচিত হয়ে বেড়ে ওঠার পথ আজ প্রায় রুদ্ধ ওদের।
পিডিএস/এমএইউ