টঙ্গী (গাজীপুর) প্রতিনিধি
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
সন্ধ্যা হলেই অনিরাপদ টঙ্গী, ঘটছে প্রাণহানী
২৮টি স্পটে ছিনতাইয়ের উপদ্রপ
টঙ্গী গাজীপুরা এলাকায় থেকে স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় অপারেটরের কাজ করে ফরহাদ হোসেন। গতকাল শুক্রবার রাত ১১টার দিকে কারখানা থেকে বাসায় ফেরার পথে কয়েক তরুণ সুইচ গিয়ার চাকু হাতে তার গতি রোধ করে ছিনিয়ে নেয় মোবাইল ফোন ও টাকা। এ সময় বাধা দেওয়ায় তার হাতে চাকু দিয়ে আঘাত করে ছিনতাইকারীরা।
শুধু ফরহাদ নয়, কয়েক মাস ধরে গাজীপুরের টঙ্গীতে প্রতিদিনই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সপ্তাহখানেক ধরে প্রতিদিনের সংবাদের অনুসন্ধানে টঙ্গীতে ছিনতাই প্রবণ ২৮টি স্পটের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব স্থানে একের পর এক ছিনতাইর ঘটনায় কেউ সর্বস্ব হারাচ্ছেন, আবার কারো দিতে হচ্ছে প্রাণ।
গত মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকা আঘাতে জাফরউল্লা নামে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। তার আগে ৩ সেপ্টেম্বর রাতে এরশাদ নগর টেকবাড়ি সড়কের পাশে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ফরিদ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়।
- সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ছুরিকাঘাতে দুজনের মৃত্যু
- সপ্তাহে ২০-২৫টি ছিনতাই, বেশির ভাগ ঘটনায় মামলা নেই
- ছিনতাই হলেও ‘ডাকাতির প্রস্তুতির’ দেখিয়ে মামলা গ্রহণ
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে ধরা পড়ছেন একই ব্যক্তি
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কয়েক মাস ধরে সন্ধ্যার পর থেকে টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানার বিভিন্ন এলাকা ছিনতাইকারীদের দখলে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় চুরি-ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়ছে বলে দাবি তাদের। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
প্রতি মাসের শুরুতে টঙ্গীতে ছিনতাই বেড়ে যায়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পঘন এ এলাকায় ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি ও পকেটমারি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। তবে এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয় খুব কম।
টঙ্গীতে ছিনতাই প্রবণ ২৮টি স্পটের সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে একা চলাচল করা অনিরাপদ হয়ে উঠছে। স্টেশনরোড ও উড়াল সেতু, নতুন বাজার, রেল স্টেশন, টঙ্গী বাজার ও উড়াল সেতু, আব্দুল্লাহপুর, নদী বন্দর, হাজী মাজার বস্তি, মিরাশ পাড়া, আরিচপুর, শিলমুন, মরকুন, হকের মোড়, আমতলী, নিমতলী, টঙ্গী রেল ব্রিজ, সান্দার পাড়া, দত্তপাড়া, প্রত্যাশা মাঠ, কলেজ গেট, শফিউদ্দিন সরকার রোড, হোসেন মার্কেট, এরশাদ নগর বাশপট্রি খরতৈল, সাতাইশ বাগানবাড়ি, হোসেন মার্কেট, বড় দেওড়া সিংবাড়ি মোড়, কামারপাড়া রোডের মাথা, গুটিয়া ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, গাজীপুরা খাঁ-পাড়া, তিলারগাঁতি, দিঘীরপাড়। এসব এলাকা সন্ধ্যার পর চলে যায় ছিনতাইকারীদের দখলে। টঙ্গী এলাকাবাসীর ভাষ্য, এসব এলাকায় সপ্তাহে অন্তত ২০-২৫টি ছিনতাই ঘটে। তবে বেশির ভাগ ঘটনায় পুলিশ মামলা নেয় না। মামলা হলেও ছিনতাই হিসেবে না দেখিয়ে ডাকাতির প্রস্তুতির মামলা গ্রহণ করা হয়।
চলতি বছরের ১২ অক্টোবর রাত ৯টায় মিলগেট এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন হা-মীম গ্রুপের সিসিএল-৩ এর কাটিং ম্যানেজার কামাল উদ্দিন। অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় অলিম্পিয়ার ভিতরে দুজন ছিনতাইকারী চাকুর ভয় দেখিয়ে তার সঙ্গে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনয়ে নেওয়া চেষ্টা করে। পরে অন্য শ্রমিকরা দুজন ছিনতাইকারীকে ধরে পুলিশে দেয়। তাছাড়া এই এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
১৬ অক্টোবর রাতে দত্তপাড়া তিসতার গেট এলাকায় সাব্বির হোসেন (১৮) নামে এক যুবক ছিনতাইকারী সন্দেহে জনতার মারধরে নিহত হয়। এ ঘটনায় মেজবাহ উদ্দিন (৩৬) নামে একজন আহত হয়েছেন।
২৩ অক্টোবর ভোর পাঁচটায় রেলগেট এলাকায় সেলিম বেপারীর কাছ থেকে তার ব্যবহার করা মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। সেলিম বেপারী বলেন, ‘সকাল বেলা হাটতে বের হয়েছি। এসময় ছিনতাইকারীরা আমার হাত থেকে ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়।’ এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হবে তিনি জানান।
পোশাককর্মী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘২০ অক্টোবর সন্ধায় গাজীপুরা বাঁশপত্তি এলাকায় তিন-চারজন ছিনতাইকারী আমাকে আটকায়। এ সময় তারা ছুড়ি ও খুরের ভয় দেখিয়ে আমার কাছে থাকা ব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’ এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘থানায় অভিযোগ করে লাভ নাই। যা গেছে তা কি আর ফেরত পাওয়া যাবে?’ টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা সূত্রে গেছে, গত এক সপ্তাহে এ দুই থানায় ছিনতাই ও ডাকাতির প্রস্তুতির মামলা হয়েছে ৪৩টি। এর মধ্যে পূর্ব থানায় ছিনতাইকারী ১৫ জন, চুরির মামলায় দুজন, হত্যা মামলায় তিনজন, ওয়ারেন্ট চারজন ও অন্যান্য মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর পশ্চিম থানায় হওয়া ছিনতাইকারী ছয়জন, ডাকাতি প্রস্তুতি মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে টঙ্গী রেল স্টেশনে ট্রেনে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। স্টেশনে আসা মাত্রই ট্রেনটি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে থাকে ছিনতাইকারীরা, পরে আতঙ্কিত যাত্রীরা আত্মরক্ষার্থে ছুটাছুটি শুরু করে। এই সময় বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে যায় তারা। এছাড়া রেলগাড়ির জানালা দিয়ে যাত্রীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
মোশারফ বললেন, ‘স্টেশন রোড এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটছে প্রতিদিন। নারীদের কানের দুল ও মোবাইল ফোন চক্রটির প্রধান টার্গেট।’
রাকিবুল বলেন, ‘২৪ সেপ্টেম্বর কামারপাড়া রোডে অল্পবয়সী ৩-৪ ছেলে পথ আটকেই আমাকে চড়থাপ্পড় মারতে থাকে। পরে ছুরি বের করে ভয় দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।’ কয়েক মাস আগেও ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তখন থানায় গিয়েও লাভ হয়নি। তাই ঘটনার পর আর পুলিশের ধারেকাছেও যাননি।
টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কায়সার আহমদ বলেন, ‘এক সপ্তাহ হয়েছে পূর্ব থানায় যোগদান করেছি। এক সপ্তাহের মধ্যে চুরি-ছিনতাই, হত্যা, ওয়ারেন্টসহ অন্যান্য মামলায় ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাদক, চুরি-ছিনতাই ঘটনাসহ বিভিন্ন অপরাদের সঙ্গে কোনো আপোষ নাই। এ সব ঘটনায় আমাদের অভিযান অভ্যাহত আছে। আমরা টঙ্গীর জনগণের সহযোগীতা চাই।’ গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ-দক্ষিণ) আলমগীর হোসেন বলেন, ‘টঙ্গী ঘণবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে অনেক বস্তি রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে বেকার। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে ছিনতাই কমে যেতে পারে ধার না করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেখা যায়, ঘুরে ফিরে একই ব্যক্তিকে ধরা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইকারি ধরে চালান দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন ছিনতাই কমে আসছে। আমাদের অভিযান অভ্যাহত আছে।