ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
শেষ হলো ওরাঁওদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব কারাম উৎসব
সবার সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে ঠাকুরগাঁওয়ে ওরাঁও সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব কারাম পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে সাড়ে ৯টার দিকে জেলার সদর উপজেলার সালন্দর পাঁচ পীরডাঙ্গা গ্রামের ওরাঁও মহল্লায় কারাম উৎসব পালিত হয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার এর আয়োজন করে।
পূজা অর্চনা শেষে গ্রামের সব বয়সের নারী-পুরুষরা বুধবার দুপুরে আবারও ঢাক-ঢোলের তালে নেচে-গেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কারাম বৃক্ষের ডাল নদীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দিয়ে এ বছরের মতো শেষ করবেন কারাম উৎসব।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মনি কেরকেটা বলেন, ‘আমরা এখানে আদিকাল থেকে ও যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় কারাম পূজা ও উৎসব করে আসছি। মূলত বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং ভালো ফসল উৎপাদন হওয়ার কামনায় এই পূজা আমরা করে থাকি।’
কারাম একটি গাছের নাম। ওরাঁও জনগোষ্ঠীর কাছে এটি একটি পবিত্র গাছ, মঙ্গলেরও প্রতীক। তারা মনে করেন, কারাম গাছের ডাল যুগে যুগে তাদের বিপদ-আপদ থেকে শুরু করে মহাপ্রলয় হতে রক্ষা করে। প্রতি বছর বাংলা ভাদ্র মাসের শেষে ও আশ্বিনের শুরুতে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনায় এই গাছের ডালকে পূজা অর্চনা করেন ওরাঁও সম্প্রদায়ের মানুষেরা।
প্রতি বছরের মতো উৎসবে ওরাঁও সম্প্রদায়ের লোকজন উপবাস করে কারাম গাছের ডাল কেটে এনে স্থায়ী ও অস্থায়ী পূজা মন্ডপে পুঁতে রেখে পূজা-অর্চনা করেন। পরে ঢাক-ঢোলের তালে নাচে-গানে ও গল্প বলার মধ্যদিয়ে এ উৎসব শুরু হয়। পুরো এলাকা মুখরিত হয় এ উৎসবে। ওরাঁওসহ হিন্দু, মুসলিম মিলে প্রায় সব সম্প্রদায়ের ছোট বড় সব বয়সের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় পাঁচ পীরডাঙ্গা গ্রাম।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা ইমরান চৌধুরী বলেন, জলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের সার্বিক সহযোগিতায় কারাম উৎসব হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের সব সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই উৎসবে সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ করেন। এটি এখানকার ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহ অবস্থানের একটা সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর ঠাকুরগাঁও জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রিজ বলেন, ‘আমি এই উৎসবে প্রতি বছরই আসি। এসে তাদের উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। কারাম উৎসব একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। ওরাঁও সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, তাই আমি চাই রাষ্ট্রীয় ও সরকারিভাবে তাদের সহযোগিতা করার মাধ্যমে উৎসবটি যেন ভবিষ্যতে প্রতিবছর আরও বড় পরিসরে পালন করা হয়।’
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নরেন চন্দ্র পাহান জানান, ‘আদিবাসীদের দুই সহোদরÑ ধর্মা ও কর্মা। ধর্মা কারাম গাছকে পূজা করত, কিন্তু কর্মা একদিন সেই গাছ তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দেন। তখন নানা বিপদ-আপদ ও অভাব দেখা দিলে আবার সেই গাছ খুঁজে আনা হয়। তখন থেকে সেই গাছকে বিশ্বাস করে ধর্ম পালন করায় ধর্মা রক্ষা পান সব বিপদের হাত থেকে। আর কর্মা ধর্ম পালন না করায় ক্ষতির সম্মুখিন হন। তখন থেকেই বিপদ-আপদ ও অভাব-অনটন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মূলত কারাম পূজা করা হয়।’
কারাম উৎসব দেখতে স্থানীয় বাসিন্দাসহ অন্যান্য জেলা থেকে আসা লোকজন জানান, একই রঙের পোশাক পরে সারিবদ্ধভাবে গ্রামের নারী পুরুষরা ঢোলের তালে তালে কারামের নৃত্য পরিবেশন দেখে তারা আনন্দিত ও খুশি ।
পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বিশ্বনাথ কেউকেটার সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতা, সালন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে এলাহী মুকুট চৌধুরী, ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লুৎফর রহমান মিঠু সহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।