মাহফুজুর রহমান, মুরাদনগর (কুমিল্লা)
‘বিজয়’ নিয়ে ঘরে ফেরার কথা জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ
পরিবারের সদস্যদের না জানিয়েই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। পুলিশের গুলিতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে তার পরিবার জানতে পারে আন্দোলনে যাওয়ার কথা। তখন আসিফকে বাড়ি ফিরে আসতে অনুরোধ করেন স্বজনরা। আসিফ জানায়, মৃত্যু হলেও বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তিনি ঘরে ফিরবেন না।
পরিবারের সদস্যদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আসিফ জানান, তিনি আন্দোলন থেকে একপাও পিছপা হবেন না। এতে যদি তার মৃত্যু হয়, হবে। এরপর থেকেই আসিফ মাহমুদের পরিবারে আতঙ্ক শুরু হয় বলে জানান তার ছোট বোন ইফাত জাহান লামিয়া।
ইফাত জাহান লামিয়া বলেন, আসিফ পাঁচদিন নিখোঁজ থাকার সময় তাদের ঘরে রান্না হয়নি। আমার মা-বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমরা লাশ ঘরে গিয়েও ভাইকে অনেক খুঁজেছি। আন্দোলন সফল হওয়ায় আমাদের অনেক ভাল লাগছে।
জানা যায়, কোটা সংস্কারের লক্ষে শুরু হওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ঢাবি শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার আকুবপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম বিল্লাল হোসেনের ছেলে। তিনি আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার মা রোকসানা আক্তার গৃহিনী।
আসিফের বাবা বিল্লাল হোসেন জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়ার খবর পেয়ে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। অজানা আতংক আর উৎকন্ঠা নিয়ে প্রতিদিন আসিফের সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু ১৯ জুলাই তার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন জায়গায় তাকে খোঁজ করেও পাইনি। তখন আমরা একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়ি। ২৩ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়, আসিফ মাহমুদকে গুম করা হয়েছে। তারপর আমরা ঢাকার শাহবাগ থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করতে গেলে ওসি আমাদের জিডি নেয়নি। সেখানে থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় যাই, সেখানেও একইভাবে আমাদের ফিরিয়ে দেয় পুলিশ।
তারপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে প্রতিটা ওয়ার্ডে খোঁজ করি। কিন্তু আসিফের কোন সন্ধান পাইনি। হতাশ হয়ে আমরা হাসপাতালের লাশঘরে গিয়ে তাকে খুঁজি। সেখানে না পেয়ে প্রেসক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আসিফের গুমের বিষয়টি দেশবাসীকে জানাই। ২৪ জুলাই ঢাকার হাতিরঝিল এলাকায় আসিফ মাহমুদকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। এসময় তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিলে সেখান থেকে ২৬ জুলাই পুলিশ পরিচয়ে আবারো তাকে তুলে নিয়ে যায়। ২৭ জুলাই ডিবি কার্যালয় থেকে ফোন করে জানায় আপনার ছেলে ডিবি কার্যালয় আছে। আমি আর আসিফের মা সেখানে গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করি। তখন ডিবি পুলিশ জানায় আসিফসহ ছয় সমন্বয়কে তারা ছেড়ে দেবে। কিন্তু ছাড়েনি। তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন আমার থেকে ভিডিও রেকর্ড নিতে চেয়েছিলো যে সমন্বয়করা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা সেচ্ছায় দিয়েছে। কিন্তু আমি রাজি হইনি। একদিন পর আবারো ফোন করে আমাদের যেতে বলে, তখন তাদের গাড়ি দিয়ে আসিফসহ আমাদের বাড়ি পৌছে দেয়। তিনি বলেন, আসিফ ছোট্টবেলা থেকেই প্রতিবাদী ছিলো। যেখানে অন্যায় দেখতো, সেখানেই প্রতিবাদ করতো। তিনি এই আন্দোলনে নিহত সবার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়াসহ সব সমন্বয়ক এবং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তার দাবিও করেন। অজোপাড়া গায়ের ছেলে আসিফ মাহমুদের এমন সাফল্যে এলাবাসীও আনন্দিত।