র্যাপ গান: ছাত্র আন্দোলনে একালের “চরমপত্র”
জেনারেশন জেড বা জেনারেশন জি কারা তা নিয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে ছোট্ট করে বললে, যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে তাদেরকে GEN-Z বা GEN-G বলা হয়। জেনারেশন জেড হল ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে জন্ম নেয়া মিলেনিয়াল বা জেনারেশন ওয়াই (GEN-Y) এর পরের প্রজন্ম।
১৯৭০-এর দশকে নিউইয়র্ক সিটিতে র্যাপ গানের সূচনা হলেও বাংলাদেশে এই ধারার গান জনপ্রিয়তা পায় ২০০৫ সালের পরে। র্যাপার ফকির লালের “একলা একশো” অ্যালবাম প্রকাশের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) ইউনিট বিক্রি হয়। এরপর জোয়ার আসে বাংলা র্যাপ গানের জগতে। তৈরি হয় নানা ব্যান্ড দল। GEN-Z প্রজন্মের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো, সোজা কথা সোজাসুজি বলা। এই চর্চার সঙ্গেই র্যাপ গানের মূল যোগাযোগ। র্যাপ গান কথা প্রধান। আর এর লিরিক হয় সোজাসাপ্টা এবং তীক্ষ্ণ। GEN-Z এর ছেলেমেয়েরা গানের মধ্যে বিট খুব পছন্দ করে থাকে। এদিক দিয়েও র্যাপ গান তাদের খোরাক জোগায়। এজন্য জেড জেনারেশনের কাছে অন্য সব গানের চেয়ে র্যাপ একটু বেশিই প্রিয়।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা যুক্ত হয়েছেন তারা সবাই জেড জেনারেশনের। ২০১৮ সালে যে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছিলো তার নেতৃত্ব এবং বড় অংশই ছিল GEN-Y প্রজন্ম। একই বিষয়ে দুই সময়ের আন্দোলনে যুক্ত হওয়া শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্যগত নানা পার্থক্য আছে। আমরা যদি সেই আন্দোলনের সময়ের প্ল্যাকার্ড এবং শ্লোগানের দিকে নজর দেই তাহলে বড় একটা পার্থক্য দেখতে পাবো। সেই সময়ের আন্দোলনকারীরা যে কথা ভাবতেও পারেনি, এ সময়ের ছেলেমেয়েরা অনায়াসেই বলে ফেলেছে তা। ১৮’র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারকে স্বৈরাচারী বলতে গিয়ে কয়েক দফা ঢোক গিলতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। আর এ সময়ে এসে আন্দোলনকারীরা সরকার পতনের এক দফা দাবি বাস্তবায়ন করেছেন। মূল কথায় আসি, GEN-Z প্রজন্ম যা চায়, তা কী করে পেতে হয় বা আদায় করে নিতে হয় তা ভালো করেই জানে।
৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জোগাতে গান ও কবিতা কতটা শক্তি জুগিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আর আখতার মুকুলের “চরমপত্র” শুনে কত মানুষ যে নতুন করে যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে তা তো সবার জানা। আর ঝিমিয়ে পড়া যোদ্ধাদের শরীরে প্রাণ সঞ্চারে চরমপত্রের ভূমিকা নতুন করে বলার কিছু নাই। ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে ব্যাপকহারে বিদ্রোহী র্যাপ গান নির্মাণ করা হয়। বিজয়ের আগ পর্যন্ত (৫ আগস্ট ২০২৪) পঞ্চাশের অধিক র্যাপ গান ইউটিউবে প্রকাশ পায়। যার সব শিল্পীই জেড জেনারেশনের। সোজাসাপ্টা ও তীক্ষ্ণ বুলির গানগুলো আন্দোলনকারীদের রক্তে বারুদের মতো কাজ করে। একেকটা গান শোনার পর, শ্রোতাদের মাঝে রাজপথে নামার উত্তেজনা তৈরি হয়। ঠিক এই কারণেই হয়ত ‘আওয়াজ উডা’ শিরোনামের গানের জন্য গায়ক হান্নান হোসাইন শিমুলকে গ্রেপ্তার করে দুইদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত র্যাপ গানের সাথে ৭১-এ প্রচারিত চরমপত্র’র বহু জায়গায় মিল আছে। চরমপত্রে যুদ্ধকালীন বীর যোদ্ধাদের নানা বীরত্বের পাশাপাশি পাকবাহিনীর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের উল্লেখ আছে। ছাত্র আন্দোলনের র্যাপ গানগুলোর মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের নির্মম অত্যাচারের বর্ণনা আছে। একই সাথে আন্দোলকারীদের মনবল চাঙা রাখতে প্রচার করা হচ্ছে নানা বাণী। প্রকরণ ও অবতরণগত মিলের পাশাপাশি রয়েছে ভাষাগত মিলও। চরমপত্রের ভাষা ছিল ঢাকাইয়া ও আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ। র্যাপ গানের ক্ষেত্রে শুধু ঢাকাইয়া ও আঞ্চলিক ভাষাই নয়, রয়েছে আন্তর্জাতিক একাধিক ভাষার সংযোগ। জেড জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা যেহেতু বৈশ্বিক নাগরিক, সেহেতু আত্মর্জাতিক ভাষার মিশ্রণ খুব স্বাভাবিক বিষয়। এই মিশ্রণী ভাষার কারণে গানগুলোর মাঝে অন্যরকম এক মাদকতা তৈরি হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে নির্মাণ করা র্যাপ গানের কয়েকটিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে বলতে হলে, “আওয়াজ উডা“, “দেশ সংস্কার”, “গদি ছাড়” গানের কথা উল্লেখ করা যায়। গানের মধ্যে এভাবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ব্যবহার করে একটা বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, শেখ হাসিনার সরকার যেই বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ হিসেবে প্রচার করে এসেছে, সেই বুলি শুধুই ঠকবাজি। এছাড়া এএস অমির “রক্ত” গানে শেখ হাসিনার কয়েকটি ভাষণ যুক্ত করা হয়েছে। সেখানেও স্পষ্টতই সরকারের বক্তব্যকে খারিজ করে দেয়া হয়েছে, বাতিল করে প্রচার করা হয়েছে প্রতিবাদী ভাষা। বেশ কিছু গানের মাঝে আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয়েছে। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এই গানগুলো শুধু গান হিসেবে না থেকে একেকটি প্রতিবেদন হিসেবেও প্রচার হচ্ছে। এভাবেও যে সংবাদ প্রচার করা যায় তা জেড জেনারেশনের আগে কেউ ভেবেছে কি-না জানা নাই।
এরই মধ্যে (৮ আগস্ট ২০২৪) ইউটিউব ট্রেন্ডিয়ে প্রথম ৩০ গানের মধ্যে আন্দোলন নিয়ে লেখা ৪টি গান জায়গা করে নিয়েছে। হান্নানের “আওয়াজ উডা” গানটি ২য় স্থানে আছে, সেজানের “কথা ক” আছে তৃতীয় স্থানে। এতে বোঝা যায়, আন্দোলন শেষ হলেও বর্তমান সময়ে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই র্যাপ সংগীত। সবশেষে কয়েকটি গানের আগুনজ্বলা লিরিক তুলে ধরা হলো...
জোর যার মুল্লুক তার, আগে ক মুল্লুক কার?
লাঠির জোরে কলম ভাঙ্গে, শান্তির নামে তুললো খার
কাইল মারলি, পরশু মারলি, মারতে আইলি আজ আবার!
রাজায় যহন প্রজার জান লয়, জিগা তাইলে রাজা কার?
জবান খুললেই জবান সিলাই, আর সিলাইবো কয়জনের
একজনে মা পইড়া গেলেও খাড়ায় যাইবো ছয় জনে
--- --- কথা ক / সেজান
ছাত্র ছাড়া লীগ হয় নাই তর লীগের কামডা ঠিক হয় নাই
স্বাধীন বাংলা কইসে খালি বাংলা আর স্বাধীন হয় নাই
দেশ টা যে কারো বাপের একা ওর বাপে কয়া যায় নাই
হের বাপে যা কইরা গেসে ওর ভিত্তে এডি রয়া যায় নাই
--- --- আওয়াজ উডা / হান্নান
গুলি করলে মাথায় মার বুকে বঙ্গবন্ধু
এক বেঞ্চ বহা বন্ধু, কেমন চালায় বন্দুক!
সাংবাদিক সব ব্যস্ত কারণ বাম্পার ফলন টিভিতে
সাবধান পতন হইবো হিস্ট্রি গেলে রিপিটে।
--- --- চব্বিশের গেরিলা
বীর থাকে না স্থির বেটা এক পড়লে হয় একশর পয়দা
হকের কথা প্রজার মুখে স্বৈরাচারীর কানে সয় না
... ... ...
রক্ত দিতে ডরায় না কেউ, হকটা সবার সমান চাই
৫২'র তে ২৪ সালের মধ্যে কোনো তফাত নাই
--- --- বায়ান্ন / বিহান
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
সরদার মুহাম্মদ আরিফ