
বৃষ্টিতে বাড়ছে নদীর পানি বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত থেকে আজ শুক্রবার পর্যন্ত ভারী বর্ষণে বাড়ছে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও সুরমার পানি। এতে বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা করছেন বানভাসিরা। নদীতে পানি বাড়া বা কমার সময় ভাঙন শুরু হয়। যমুনার পানি বাড়ায় চৌহালীতে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। এখন উত্তরের বিভিন্ন নদীতে পানি কখনো কমছে, কখনো বাড়ছে। ফলে এই সময় দেখা দিয়েছে তীব্র নদীভাঙন। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে দুধকুমার, সঙ্কোষ ও গঙ্গাধরের পানি কমছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
সিরাজগঞ্জ : নদীর পানি কমা এবং বাড়ার সময় ভাঙন দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার রাতভর ভারী বর্ষণে সিরাজগঞ্জের যমুনা পানি আবারও বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ ফুলজোড়, ইছামতি, করতোয়া নদীর পানি। দুই দিন ধরে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধিতে নতুন করে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কাজিপুর, চৌহালী, শাহজাদপুর, বেলকুচি, এনায়েতপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়ে গেছে বলে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র থেকে প্রকাশ। পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যাকবলিত এলাকায় ৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাবুল কুমার সুত্রধর জানান, জেলার ৬,৫২৫ হেক্টর জমির পাট, তিল, কলা ও মরিচ, বীজতলা, বিভিন্ন সবজিখেত এখন পানির নিচে থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখনো ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ হয়নি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান জানান, জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নে প্লাবিত এলাকা ৩৩৫.৮৫ বর্গ কিমি। পানিবন্দি পরিবার ২১ হাজার ৪৯টি পরিবারের ৯৪ হাজার ২১৬ জন মানুষ পানিবন্দি। বরাদ্দপ্রাপ্ত ত্রাণ চাল ১৩ শত টন। নগদ টাকা ২৫ লাখ টাকা, শুকনো খাবার ১ হাজার প্যাকেট। শুক্রবার সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৩.৩৫ মিটার। পানি বেড়েছে ৫ সেমি। বিপৎসীমার ৪৫ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাজিপুর মেঘাই পয়েন্টে রেকর্ড করা হয়েছে ১৫.০৫ মিটার। পানি বেড়েছে ৫ সেমি। বিপৎসীমার ২৫ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান।
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) : যমুনার পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হয়েছে। সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ১২ সেমি বেড়ে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার বাঘুটিয়া, খাষপুখুরিয়া, সদিয়াচাঁদপুর, স্থলচর, ঘোরজান, উমারপুর, খাষকাউলিয়া ও এনায়েতপুরে যমুনার ভাঙন শুরু হয়েছে। বাঘুটিয়া ইউনিয়নের শত বছরের পুরোনো চরসলিমাবাদ কবরস্থান যমুনার কড়াল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। কবরস্থানের পাশেই ভাসতে দেখা গেছে অগণিত লাশ। হুমকির মুখে পড়েছে কারিগরি কলেজ, পয়লা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়, দাখিল মাদরাসা সহ ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, বাজার ও বসতি। গত কয়েক দিনে পানি বৃদ্ধিতে উপজেলায় ৪৮ কোটি টাকার নদীশাসন বাঁধ প্রকল্পে বিভিন্ন স্থানে জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজে ধস দেখা দিয়েছে। বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ভূতের মোড় এলাকায় বসতি, পাকা সড়ক, কবরস্থান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে অনেকে ঘর ভেঙে আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড পদক্ষেপ নগণ্য বলে জানান এলাকাবাসী।
বিনানই গ্রামের মো. আল হাদি জানান, যমুনা নদীতে পানি বাড়ার কারণে গত কয়েক দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ বাড়িঘর ভেঙেছে। চরসলিমাবাদ কবরস্থান বিলীন হয়েছে ৬-৭ লাশ উদ্ধার করে অন্য কবরস্থানে দাফন করা হলেও অনেক লাশ ভেসে গেছে। হুমকির মধ্যে রয়েছে নদীশাসন বাঁধ, মিটুয়ানি বিসিএস উচ্চবিদ্যালয়, দেওয়ানগঞ্জ বাজার, মসজিদ, বিনানই বাজার, বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, সম্ভুদিয়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়, আলিম মাদরাসা, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, বাঘুটিয়া কারিগরি কলেজ, চৌবাড়িয়া সিকদারপাড়া কারিগরি কলেজ, কয়েকটি কবরস্থান, ঘরবাড়ি ফসলি জমিসহ বেশ কিছু প্রাইমারি স্কুল।
বাঘুটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আ. কালাম মোল্লা বলেন, আমরা সাহায্য চাই না টেকসই বাঁধ চাই। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. তাজ উদ্দিন বলেন, চৌহালীর পূর্ব অঞ্চল রক্ষায় সরকার ৪৮ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন, তারই আলোকে বাঘুটিয়া ভূতের মোড় এলাকার শিক্ষাঙ্গনসহ সবকিছু রক্ষা করতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং অব্যাহত থাকবে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, ভাঙন এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে ৬ হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। আশা করি আগামী শুষ্ক মৌসুমে শতভাগ ডাম্পিং কাজ শেষ হলে ভাঙন রোধ হবে ইনশাআল্লাহ।
সুনামগঞ্জ : এক মাস ধরে দফায় দফায় বন্যার কবলে আছে সুনামগঞ্জবাসী। এখন বৃষ্টি দেখলেই মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। তিন দিন ধরে আবারও টানা বৃষ্টিতে দ্রুত বাড়ছে সুরমা নদীর পানি। গতকাল বিকেল ৪টা পর্যন্ত সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৭ সেমি ওপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে বেলা ১২টা পর্যন্ত সুরমা পানি বিপৎসীমার ৩০ সেমি ওপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। ১২টার পর থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। তবে আবারও আগামী ৪৮ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
দ্বিতীয় বন্যার পানিও নামছে ধীরগতিতে এর মধ্যে আবারও বৃষ্টিপাতে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুরমা তীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে নতুন করে। আবারও পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলায় আরো ভোগান্তি বেড়েছে। সীমান্ত নদী যাদুকাটা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তাহিরপুর সুনামগঞ্জ সড়কের শক্তিয়ারখলা অংশে মৌসুমের তৃতীয়বারের মতো পানিতে তলিয়েছে। এতে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
তাহিরপুর উপজেলার বাণিজ্যিক এলাকা বাদাঘাটের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন হয়ে গেছে। সড়কের কোনো কোনো অংশে হাঁটু পানির ওপরে, এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এই সড়কের আশপাশের বাসিন্দাদের।
গত দিন দিনে দেশের অভ্যন্তরে ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অধিক বর্ষণের ফলে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার বিশ^ম্ভরপুর, তাহিরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তত ২ লক্ষাধিক মানুষ আবারও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুই দফা বন্যার পানিই জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসা-বাড়িতে ও সড়কে দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আবারও পানি বৃদ্ধিতে অসহায়ত্ব দেখা দিয়েছে পানিবন্দি মানুষের মাঝে।
গত দুই দফা বন্যায় সুনামগঞ্জের ২২ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়ক নষ্ট হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন, ভারতের উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে আরো বৃষ্টিপাত হতে পারে। এই সময়ে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাবে। তবে বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না।
নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) : কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে দুধকুমার, সঙ্কোষ ও গঙ্গাধর নদীর পানি কখনো বাড়ছে কখনো কমছে। বর্তমানে নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। সবমিলে বন্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির লক্ষণ বোঝা গেলেও দুর্ভোগ কমছে না বানভাসিদের। অধিকাংশ বানভাসিদের ঘরদোরের পানি সরেনি। শিশু বৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে তাদের দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে দুধকুমার নদের পানি গত বুধবার থেকে বাড়ছিল, এ সময় বিপৎসীমার ৫০ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আবার গত বৃহস্পতিবার বেড়ে পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩ সেমি এবং ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৪ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর পানি কমে দুধকুমার নদের পানি গতকাল সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে কিছুটা কমে ২৫ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে নুনখাওয়া, নারায়ণপুর ও ভিতরবন্দ ইউনিয়নের বেশকিছু এলাকার ঘরবাড়িতে এখনো পানি রয়েছে। এছাড়া রায়গঞ্জ, বামনডাঙ্গা, বল্লভেরখাস, কচাকাটা, কালিগঞ্জ, ইউনিয়নের অনেক এলাকার ঘরবাড়িতে পানি রয়েছে।
বরাবরের মতোই বন্যাকবলিত এসব এলাকায় শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানি দূষিত হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে রোগবালাই। কেউ কেউ উঁচু জায়গা, রাস্তার ওপর ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ চৌকির ওপর কিংবা উঁচু মাচা পেতে সেখানেই রাত কাটাচ্ছেন। রান্নাঘরে পানি, তাই চুলা জ্বলছে না। কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে গিয়ে রান্নার কাজ সারছেন। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন তারা। গোচারণভূমি তলিয়ে থাকায় পশুখাদ্য নিয়েও চরম দুশ্চিন্তায় খামারি ও কৃষকরা।
এদিকে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসছে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। পাট, আমনের বীজতলাসহ বিভিন্ন শাকসবজির খেত পানির নিচে থাকায় সেগুলোও পঁচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বন্যাকবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রয়েছে প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে। বেশ কয়েকটি গ্রামীণ সড়ক বন্যায় ভেঙে গিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
দুধকুমার নদের অববাহিকায় বামনডাঙা ইউনিয়নের ফলিমারী বাসিন্দা নুর ইসলাম জানান, তার ৩৩টি গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। নিজেদের খাবারের উপায় নেই এর মধ্যে ২ সপ্তাহ থেকে চরগুলো পানিতে তলিয়ে থাকায় গরুকে খাওয়ানোর কিছু নেই। না খেয়ে গরুগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। আনছারহাট এলাকার ঝড়– মিয়া বলেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার পাই না। রান্নাবান্না নাই। ভিতরবন্দ ইউনিয়নের বাদশা মিয়া বলেন, ‘বাড়িতে পানি থাকায় গরু ছাগল ও বাচ্চাকাচ্চা নিয়া রাস্তাত আছি। কী খাই কী না খাই তার ঠিক নাই। সকাল তাকি দুকান পাউরুটি খায়া আছি।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিব্বির আহমেদ বলেন, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি।