প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৬ নভেম্বর, ২০২৩

অবরোধে অচল পর্যটনের চাকা

ছবি: প্রতিদিনের সংবাদ

বছরের এ সময় পর্যটন মৌসুম শুরু হলেও কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা ও সিলেটের বিভিন্ন কেন্দ্রে পর্যটক কমেছে; তেমনি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে পর্যটক কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বিএনপি-জামায়াতের দফায় দফায় অবরোধের ফলে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে পর্যটন মৌসুম শীতের শুরুতে লাভের বদলে লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা।

আমাদের কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সিলেট, বাগেরহাটের মোংলা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থা।

কক্সবাজারে চলছে কর্মচারী ছাঁটাই : কক্সবাজার হোটেল মোটেল জোন, মেরিন ড্রাইভ সড়ক, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে প্রায় পাঁচ শতাধিকের হোটেল-মোটেল গেস্ট রয়েছে। যেখানে রাত্রী যাপনের সুযোগ রয়েছে লক্ষাধিক ব্যক্তির। সরকারি ছুটির দিনে ৭০-৮০ শতাংশ রুম বুকিং থাকে। এছাড়া বিশেষ দিনে ৯০-৯৫ শতাংশ রুম বুকিং হয়। এদিকে সৈকত ছুটির দিন ছাড়াও ৩০-৪০ হাজার পর্যটক থাকে। ছুটির দিনগুলোতে এই সংখ্যা লক্ষাধিক হয়ে যায়। হরতাল ও অবরোধের কর্মচঞ্চল হোটেল-মোটেল জোনে এখন পর্যটক নেই বললে চলে।

সুগন্ধার ঝিনুক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জানান, শীত মৌসুমকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু চলমান রাজনীতি পরিস্থিতির কারণে সবার মাঝে একটা হতাশা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় অনেকে ব্যবসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার জানান, গত দুই সপ্তাহে হোটেলের ২২ হাজার কর্মচারী ছাঁটাই হয়েছে। রাজস্ব খাতে ভ্যাট আয়করে শূন্য কোটায় পৌঁছেছে। যেখানে ৫০-৬০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ব্যবসায়ীরা।

হোটেল রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি নাঈমুল হক টুটুল বলেন, ‘অনেক খাবারের দোকান এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা দৈনিক আয়-ব্যয় নিয়ে হিসাব মেলাতে পারছে না। এমনকি নামি রেস্তোরাঁও আগের তুলনায় গেস্ট নেই। এক কথায় বলতে গেলে লোকসানে পড়েছে শত শত হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক।’

চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কক্সবাজারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘হোটেলগুলো ২০ শতাংশ পর্যটকও নেই। এই কয়দিনে ৫০-৬০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া অনেক হোটেলে কর্মচারী ছাঁটাইয়ের কারণে কয়েক হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে।’

খাগড়াছড়ির পর্যটনে ধস :

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সাজেকের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নেই পর্যটক; হোটেল বুকিং বাতিল করছেন পর্যটকরা। প্রতি বছর শীত মৌসুমের শুরুতে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র, তারেং, রিসাং ঝরনা, জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক, মায়াবিনী লেকসহ জেলার সব দর্শনীয় স্পটগুলোয় পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে। অবরোধের ফলে খাগড়াছড়ির সব পর্যটন কেন্দ্র এখন ফাঁকা।

খাগড়াছড়ি ও সাজেকে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০০ হোটেল-মোটেল, রিসোর্টে অগ্রিম বুকিং নেই। এক মাস ও পনেরো দিন আগে যারা বুকিং করেছেন, তারা এখন তা বাতিল করছেন। তেমনি পর্যটক বহনকারী পিকআপ, চাঁদের গাড়ি (জিপ), সিএনজি, মাহিন্দ্রসহ নানা ধরনের পাঁচ শতাধিক যানবাহনের চাকাও প্রায় অচল হয়ে আছে।

আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক কোকোনাথ ত্রিপুরা বলেন, শীতের শুরুতে এখন পর্যটকের ভিড় জমার কথা। কিন্তু প্রথম অবরোধ থেকে এখনো আমাদের পর্যটন কেন্দ্র পর্যটকশূন্য। ফলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কয়েক দিনের অবরোধে আমাদের ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্কের ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, শীতের শুরুতে পার্কে প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক পর্যটক বেড়াতে আসতেন। অবরোধের কারণে পার্ক এখন পর্যটকশূন্য। গত দুই সপ্তাহে অমাদের কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, দেশে খাগড়াছড়ি পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক না আসায় ব্যবসায়ীরা হতাশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘ হলে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব।

পর্যটননির্ভর অর্থনীতির চাকা স্থবির :

হরতাল-অবরোধে মুখথুবড়ে পড়েছে জেলার পর্যটননির্ভর অর্থনীতির চাকা। অবরোধের কারণে দূর পাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ফাঁকা জেলা সদরের সব আবাসিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট এবং সরকারি-বেসরকারি গেস্ট হাউসগুলো। পর্যটন স্পট নীলাচল, মেঘলা, চিম্বুক, নীলগিরি, নীলদিগন্ত, শৈলপ্রপাতসহ দর্শনীয় স্থানগুলো সবই ফাঁকা।

শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামাল বলেন, তিন শতাধিক ট্যুরিস্ট গাড়ির পাঁচ শতাধিক শ্রমিক রয়েছে। তারা পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল। অবরোধে পর্যটক না আসায় চালক শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছে। অনেকে ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত পারছে না।


  • নিরাপত্তা ও পরিবহন সংকটে কেন্দ্রগুলোতে কমে গেছে পর্যটক
  • বিভিন্ন স্থানে পর্যটন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে করা হয়েছে কর্মী ছাঁটাই
  • পর্যটননির্ভর পরিবহন ও রেস্তোরাঁ শ্রমিকরাও বেকায়দায়

নীলাম্বরী রিসোর্টের মালিক সাইদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় পর্যটন শিল্পে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে না হতেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটকদের আনাগোনা আবার থমকে গেছে। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. ফারুক হোসেন বলেন, অবরোধে পর্যটকের সংখ্যা কম। তবে একদম ফাঁকা নয়, স্থানীয় ও আশপাশের ভ্রমণকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাড়ি নিয়ে বাইরের ট্যুরিস্টরাও টুকটাক আসছে। তাদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছে। পর্যটকরা নির্বিঘ্নে ঘুরাফেরা করতে পারে।

সিলেটে পর্যটক কমছে :

সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র জাফলং, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক কমে গেছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জে পর্যটক কমছেই। সেখানকার সাদা পাথরের নৌকার মাঝি তোয়াহির মিয়া জানান, অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে হাতেগোনা পর্যটক আসছেন সাদা পাথরে। সারা দিনে একজন মাঝি একটি ট্রিপও দিতে পারেন না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার হয় না। অথচ স্বাভাবিক দিনগুলোতে প্রতিদিন ৮-১০ ট্রিপ দিয়ে থাকেন একজন মাঝি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে বলে মনে করছেন এ মাঝি।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও নির্ভানা ইনের স্বত্বাধিকারী তাহমিন আহমদ বলেন, নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ব্যবসায়ীদের দোকানপাট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এবারের অবরোধে সিলেটে প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পর্যটন খাতে।

তবে রাজনৈতিক কোনো কারণে পর্যটক কমেনি বলে জানান সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কোনো অংশে পর্যটক কম নয়। ব্যবসায়ীরা বলতে পারেন পর্যটক কম। আমাদের চোখে পর্যটক কম মনে হচ্ছে না। বুকিং বাতিল হচ্ছে কুয়াকাটায় :

রাজনীতির অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখে পড়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার পর্যটন খাত। হোটেল সি-ক্রাউনের পরিচালক সৈয়দ মো. ফিরোজ জানান, তার ২০ জন কর্মচারী, বিদ্যুৎ বিল ও অন্য খরচসহ দৈনিক ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তার হোটেলে ৬৪টি কক্ষ আছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারের জন্য বুকিং হতো ৭০ শতাংশ কক্ষ। কিন্তু হরতাল অবরোধে সব বুকিং বাতিল হয়েছে।

কুয়াকাটা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম বাচ্চু বলেন, ‘আমরা মূলত ট্যুর অপারেটর ও ঢাকার বিভিন্ন এজেন্সির পাঠানো পর্যটকদের গাইড করে থাকি। প্রায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫০ জন গাইডসহ ১৭০ জন ফটোগ্রাফার বেকার সময় কাটাচ্ছে। এভাবে আরো কত দিন থাকতে হবে সেটাও অনিশ্চিত।’ পর্যটক কমেছে সুন্দরবনে :

পর্যটন মৌসুম হিসেবে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটক। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেখা মিলছে না ভ্রমণপিপাসুদের। ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা, বেকার হয়েছেন পর্যটননির্ভর পরিবহন ও ক্ষুদ্র, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীরা।

করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, গত বছরের নভেম্বরের ১৫ তারিখে ৫ হাজার পর্যটকের আনাগোনা ছিল কিন্তু চলতি বছর এই দিনে মাত্র দেড় হাজার পর্যটকের আনাগোনা।

পিডিএস/জেডকে

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পর্যটক,পর্যটন,অবরোধ,অচল,চাকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close