কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে ডুবে আছে ৫৪ জাহাজ, ঝুঁকিতে বন্দর

চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলকে ঘিরে সচল দেশের অর্থনীতি। দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি পণ্য এ চ্যানেলে এসে খালাস হয়। অথচ পুরো চ্যানেলটি এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এ চ্যানেলের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৫৪টিরও বেশি জাহাজ ডুবে আছে। এসব ডুবন্ত জাহাজের ওপর পলি জমে বিভিন্ন স্থানে ভরাট হচ্ছে চ্যানেল। এরই মধ্যে বন্দরে বড় জাহাজের (মাদার ভ্যাসেল) আনাগোনা বাড়ছে। কিন্তু ডুবন্ত জাহাজগুলো যেকোনো বন্দরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে, তা বুঝেও নির্বিকার রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময়ের শেষ পর্যায়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ডুবে থাকা জাহাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এ ব্যাপারে মার্চেন্ট মেরিনার ক্যাপ্টেন শিমুল দত্ত প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বমানের বন্দর করতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অবশ্যই নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, ডুবে থাকা জাহাজগুলো অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কোথায় কোন জাহাজ ডুবে আছে, তার সঠিক নির্দেশনা না থাকলে বন্দরে আসা বড় জাহাজগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। জাহাজ আটকে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, বিদেশে কোনো জাহাজ ডোবার সঙ্গে সঙ্গে স্যালভেজ জাহাজের মাধ্যমে এগুলো উদ্ধার করে চ্যানেল নিরাপদ রাখা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের স্ট্রং কোনো স্যালভেজ জাহাজ নেই।’
বন্দর কর্তৃপক্ষ সচিব ওমর ফারুক জানান, ‘বন্দরে জাহাজ চলাচলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ডুবে থাকা জাহাজগুলোর কারণে এ পর্যন্ত জাহাজ চলাচলে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি।’
# ডুবে আছে ৫৪টির বেশি জাহাজ # তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না # ডুবন্ত জাহাজ তোলার প্রযুক্তি নেই # কর্তৃপক্ষ নির্বিকার
অনুসন্ধান মতে, বিশ্বমানের বন্দর তৈরির পূর্বশর্ত হলো সাগরের চ্যানেল নিরাপদ রাখা। বন্দরের কয়েক নটিক্যাল মাইল ঘিরে চলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে জাহাজ খালাস ও বোঝাইয়ের কাজ। বহির্নোঙরে বড় বাল্ক জাহাজগুলো থেকে খালাস হয় পণ্য, কন্টেইনার জাহাজগুলো কর্ণফুলীর মোহনা দিয়ে প্রবেশ করে বন্দরে। কর্ণফুলীর মোহনা থেকে শুরু করে বহির্নোঙরের বিভিন্ন এনকারেজে ডুবে আছে ৫৪টিরও বেশি ছোট-বড় জাহাজ। চ্যানেলকে হুমকির মধ্যে রাখা এসব ডুবন্ত জাহাজ তোলার আধুনিক যন্ত্রপাতি বন্দরের কাছে নেই।
জানা গেছে, বন্দর একদিকে চ্যানেলের গভীরতা বৃদ্ধির জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, কিন্তু ডুবে থাকা জাহাজের সঙ্গে বড় জাহাজ আটকে গিয়ে কী সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও কর্ণফুলীতে জাহাজডুবির ঘটনায় গতানুগতিক তদন্ত কমিটি করা এবং লাল পতাকা উড়ানো ছাড়া যেন বন্দরের আর কোনো কাজ নেই। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখে না। এতগুলো ডুবন্ত জাহাজ নিয়ে বন্দর সচল রয়েছে, বিদেশি নাবিকরা এটা বিশ্বাস করতে পারেন না, তারা আতঙ্কে ভোগেন, নানা শঙ্কা নিয়ে কাজ করেন। এসব কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
অবগত থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত দৈন্য অবস্থা ও তহবিল সংকটের দোহাই দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ডুবন্ত জাহাজগুলো উদ্ধার করছে না। ডুবে থাকা জাহাজগুলোর কারণে বন্দরের বহির্নোঙরের আলফা এনকোরেজকে অনেকে টাইম বোমার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। কারণ এখানে ডুবে আছে তেলবাহী ট্যাংকারও। তেলবাহী ট্যাংকারের সঙ্গে কোনো জাহাজের ধাক্কা লাগলে বন্দর চ্যানেল বন্ধসহ বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। একই সঙ্গে কর্ণফুলীতে ডুবে থাকা জাহাজগুলোর কারণে নদীতে বিশাল আকারের চরও গজিয়ে উঠছে। এসব জাহাজ উদ্ধারে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কেউই এগিয়ে আসছে না।
সূত্র মতে, পানিতে তলিয়ে যাওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে ১০টি জাহাজ উদ্ধারের ব্যাপারে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। ১০টি জাহাজ উদ্ধার ও প্রয়োজনীয় ড্রেজিং বাবদ ২০০ কোটি টাকার খরচ প্রয়োজন হবে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। ’৯৭-’৯৮ অর্থবছরে চালানো এ সমীক্ষায় বিপুল ব্যয়ের প্রসঙ্গটি এলে সব উদ্যোগ থেমে যায়। ২০০০ সালের দিকে ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধারে টেন্ডারও ডাকা হয়। একাধিক ঠিকাদার আগ্রহ দেখানোর পরও জাহাজ উদ্ধারের কাজ হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরসংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে বর্ষা মওসুমে সাড়ে আট ফুট ড্রাফ্টের জাহাজ প্রবেশ করতে পারে। কর্ণফুলীর নাব্যতা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাওয়ায় ভবিষ্যতে বর্তমান ড্রাফ্টের জাহাজ চলাচলও দুস্কর হয়ে পড়বে। অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বর্তমানে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ড্রাফটের গভীরতা বাড়ানোর কাজ চালাচ্ছে বলে জানায়।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর সময়ে অন্তত ৫৪টি জাহাজ বন্দর চ্যানেল, বহির্নোঙর ও বন্দরসংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে ডুবে যাওয়ার তথ্য রয়েছে। বর্তমান বাজারমূল্যে ডুবন্ত এসব জাহাজের দাম কয়েকশ কোটি টাকা। এসব জাহাজ উদ্ধার করে লোহা-লক্কর বিক্রি করলেও বিপুল কোটি টাকা আয় হবে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই জাহাজগুলো উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বন্দরের জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রতি বছর ড্রেজিং বাবদ সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে যাচ্ছে। জাহাজগুলো উদ্ধার এবং স্থায়ীভাবে ড্রেজিং করা হলে কর্তৃপক্ষের কাছে এ খরচ আর হবে না।
বন্দরের মেরিন বিভাগের তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর-সংলগ্ন কর্ণফুলী চ্যানেলে এবং বহির্নোঙরে যেসব জাহাজ ডুবে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৬৭ সালে ডুবে যাওয়া এমভি স্টার আলটায়ার ও ১৯৭১-এর বিডিআর এস বার্জ নম্বর-১১। ১৯৮৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি বহির্নোঙর এলাকায় ডুবে যায় এসএস কাওয়া নামের অপর একটি জাহাজ। একই বছর ১৭ জুলাই কর্ণফুলীতে এমভি সাগর তলিয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে বন্দরে ১ নম্বর জেটির বিপরীতে এমভি সী-হর্স নামের একটি জাহাজ ডুবে যায়। এই জাহাজের কিছু অংশ উদ্ধার করা গেলেও বেশির ভাগ ডুবে থাকে। ১৯৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি বন্দরের বহির্নোঙর এলাকায় ডুবে যায় এমভি টিনা নামের জাহাজ। ১৯৮৮ সালের চার সেপ্টেম্বর বহির্নোঙর এলাকায় ডুবে যায় এমভি লিটা। এ দুই জাহাজের কিছু কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বহির্নোঙরে ডুবে যায় এমভি রয়েল বার্ড। ১৯৯২ সালের ১৬ মে এমভি ক্রিস্টাল-৯, ১৯৯৩ সালের ২২ জুলাই ড্রাইডক জেটির কাছে ডুবে যায় আলী-৫। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর রিভার মুরিং-৮-এর কাছে ডুবে যায় বার্জ আর্গোনেট। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজডুবির বছর। এ বছর এমভি মার্জিন, এমভি ইয়াছিন, এমভি মোনালিসাসহ ৫টি জাহাজ ডুবে যায়। ১৯৯৭ সালের ৩০ জানুয়ারি বহির্নোঙরে ডুবে যায় এমভি আটলান্ডার। এর পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বন্দরে এফভি মিন সন্ধানী। ২০০০ সালে ১ নম্বর জেটিতে আগুন লেগে ডুবে যায় সাউদার্ন কুইন নামের বিশাল জাহাজটি। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি বহির্নোঙর এলাকায় মাদার ট্যাংকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুই টুকরো হয়ে মালামালসহ ডুবে যায় এমভি ফজিলত-১। একই সালের ২০ মে ডুবে ফায়ারটেক, ৩ জুলাই ডুবে বিআইডবি-টিসির জাহাজ সি-১০৬৩। ২০০৫ সালের ২ আগস্ট ডুবে এমভি ফরচুন।
২০০৭ সালে ডুবে বহির্নোঙরে ডুবে যায় লাইটারেজ জাহাজ এমভি মদিনা, ২০০৮ সালে বন্দর থেকে ৫ নটিক্যাল মাইল দূরে বাংলার সৌরভে আগুন লাগে। এ সময় ডুবে থাকা জাহাজের কারণে এটি সরাতে বেশ বেগ পেতে হয়। ২০০৯ সালে সাগরের আলফা চ্যানেলে সিমেন্ট ক্লিংকার বোঝাই জাহাজ বেঙ্গল ব্রিজ ডুবে যায়। যেখানে ৬০০ মেট্রিক টন ক্লিংকার ছিল। ২০১০ সালে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ডুবে যায় হ্যাংগ্যাং নামের একটি লাইটারেজ জাহাজ। একই সালে বহির্নোঙরে ডুবে যায় বাদুলু নামের অন্য একটি জাহাজ। ২০১২ সালে ছোট-বড় ৫টি জাহাজ ডোবার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার টন চাল নিয়ে কোরিয়ান জাহাজ হ্যাঙ্গ রো বন ডুবে যায় বহির্নোঙরে। একই সালে চট্টগ্রামের একটি বড় কোম্পানির সিমেন্ট ক্লিংকার বোঝাই দুটি জাহাজ ডুবে যায়। এর সঙ্গে রয়েছে আরো দুটি লাইটারেজ জাহাজ। ২০১৩ সালে সাগরের বি এনকারেজে সিমেন্ট ক্লিংকার বোঝাই এমভি মানিক মিয়া ডুবে যায়। ২০২০ সালে এমভি সিটি, ২০২২ সালে এমভি টিটু-১৪, ২০২৩ সালে কন্টেইনারবাহী জাহাজ পালাও এক্সপ্রেস ডুবে যায় বলে জানা গেছে।
প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজের চালকরা জানেন না বন্দরের কোথায় নিমজ্জিত জাহাজ রয়েছে। বন্দরের ভেতরে যেসব কন্টেইনার জাহাজ খালাস ও বোঝাইয়ের জন্য আনা হয় তা কোনো বিদেশি জাহাজ চালকের পক্ষে আনা সম্ভব না। বন্দরের নির্ধারিত পাইলটরাই কাজটি করে থাকেন। কারণ এখানে প্রবেশের পথটি নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। ডুবন্ত জাহাজের কারণে নৌ-চলাচলে সৃষ্টি হয় নানা প্রতিবন্ধকতা। কর্ণফুলীর মোহনা ও বহির্নোঙর চ্যানেল সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। কিছু কিছু রেকের কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়াসহ নৌ-চলাচলে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে রয়েছে এলোপাতাড়ি জাহাজের অবস্থান। কোনো শৃংখলা নেই। বহির্নোঙরে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাইয়ের কারণেই ডুবে যায় বেশিরভাগ লাইটারেজ জাহাজ।
যে হারে একের পর এক জাহাজ ডুবছে তাতে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দর পরিত্যক্ত হয় কি না, এ নিয়ে সংশয়ে আছে বিশেষজ্ঞ মহল। কারণ এত অল্পসময়ে এতগুলো জাহাজডুবি বিশ্বের কোনো বন্দরে হয়নি। জাহাজ ডুবলেও চর পড়ার আগেই জাহাজ উদ্ধার করা হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু চট্টগ্রাম বন্দর।