খালেকুজ্জামান পান্নু, পাবনা

  ০৪ জুন, ২০২৩

দখল হয়ে যাচ্ছে পাবনার ক্ষেতুপাড়া জমিদারবাড়ি 

পাবনার সাঁথিয়ায় ক্ষেতুপাড়া গ্রামে জমিদারবাড়ির মন্দির ঘেঁষে অবৈধ দখলকারীদের টিনের ঘর। সম্প্রতি তোলা ছবি : খালেকুজ্জামান পান্নু

পাবনার সাঁথিয়ার ক্ষেতুপাড়া গ্রামে ৩০০ বছর আগের জমিদারবাড়ি ক্রমশ দখল করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সরকারি এবং ঐতিহাসিক এই সম্পত্তি বেআইনি দখলদারদের কাছে থেকে উদ্ধার করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা বলেছেন, সরকারি এই জামির এখন আনুমানিক মূল্য হবে ১০ কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে জমিদার বাড়ির গোমস্তা জ্ঞানেন্দ্র তালুকদারের সন্তানরা এই জমিদারবাড়ির জমির জাল দলিল তৈরি করে ক্রয়সূত্রে মালিকানা দাবি করেছে। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে মামলা চলছে।

প্রায় ৩০০ বছর আগে নব কুমার নামে এক জমিদার সাঁথিয়া উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের গোলাবাড়ি গ্রামে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। ১৫৪টি তৌজি নিয়ে তার জমিদারি ছিল। জমিদার নব কুমার রায় মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র ছেলে পার্বতী চরণ রায় ৬০ বছর এখানে জমিদারি করেন। জমিদার নব কুমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও তার ছেলে পার্বতী চরণ রায় সম্পর্কে জানা যায়। এ বিষয়ে জমিদার শ্যামাচরণ রায়ের নাতি সুমন রায় জানান পার্বতী চরণ রায়ের চার পুত্রসন্তান ছিল। পুত্ররা হলেন বামা চরণ রায়, শ্যামা চরণ রায়, নলিনী রায় (রামাচরণ রায়) ও হেমন্ত রায়। তাদের বাবা পার্বতী চরণ রায় মারা যাওয়ার পর তিন ভাই ভারতে চলে গেলেও এক পুত্র শ্যামা চরণ রায় সাঁথিয়ায় থেকে যান। এ জমিদার বংশের অন্যতম প্রাণপুরুষ শ্যামা চরণ রায় একজন বিদ্যানুরাগী ও সমাজসেবক ছিলেন। তিনি সাঁথিয়া উপজেলা সদরের সাঁথিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও সাঁথিয়া কামিল মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জায়গা দানসহ অনেক সেবামূলক কাজ করে গেছেন। শ্যামা চরণ রায় মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র ছেলে দীপক কুমার রায় সংসারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর দীপক কুমার রায়ের মা অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিয়ে পাবনা শহরের কাচাড়ীপাড়া গ্লোব ম্যানসনে অবস্থান করেন। এরই মধ্যে দেশে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ লেগে যায়। একপর্যায়ে জমিদারের জমিজমা বাড়িঘর সবকিছু দখল করে নেয় জমিদারের গোমস্তা জ্ঞানেন্দ্র তালুকদারের লোকজন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষেতুপাড়া জমিদার বাড়ি যেতে দিত না দখলদাররা। এরপর দীপক কুমার রায় বিয়ে করেন শহরের রাধানগরে। একপর্যায়ে ওই সম্পত্তি সরকারের ১নং খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত হয়। শ্যামাচরণ রায়ের নাতি সুমন কুমার রায় আরো বলেন, তিনি সরকারের কাছে জমিদার শ্যামাচরণ রায়ের ওয়ারিশ সূত্রে ওই জমির মালিকানা দাবি করেন।

সাঁথিয়া উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ক্ষেতুপাড়া গ্রামের জমিদার শ্যামাচরণ রায় দীর্ঘদিন আগে ১ দশমিক ১৯ একর জায়গার ওপর পুকুর ও ১ দশমিক ৬ একর জমির ওপর পাকা বাড়ি ফেলে ভারতে চলে যান। যার কিছু অংশ বর্তমানে ইউনিয়ন তহসিল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এ জমি ও পুকুর গ্রাস করার লক্ষ্যে একই গ্রামের জ্ঞানেন্দ্রনাথ তালুকদার, তার ছেলে উত্তম কুমার তালুকদার ও স্ত্রী সন্ধ্যা রানী ভূতপূর্ব তহসিলদার ইরাদ মিয়া ও রজব আলীর সহায়তায় জাল দলিল তৈরি করে তা গ্রাস করার অপচেষ্টা করেন। এরই মধ্যে কয়েকটি জাল কাগজ তৈরির মাধ্যমে তারা মালিক সেজে প্রথমে পাবনা সহকারী জজ আদালতে মালিকানা দাবি করে মামলা করেন। সেখানে মামলায় তারা হেরে গেলে সাবজজ আদালতে আপিল করেন। সেখানেও তারা হেরে গেলে সর্বশেষ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন এবং যথারীতি হেরে যান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাদী উত্তম কুমার তালুকদার গংরা অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (রাজস্ব)পাবনা আদালতে ৩৩/২০ নং মিস মামলা করেন।

এই জমির মালিকানা দাবিদার ও জবরদখল করে থাকা জ্ঞানেন্দ্রনাথ তালুকদারের বড় ছেলে উত্তম কুমার তালুকদার জানান, ১৯৭০ সালে জমিদার শ্যামাচরণের ছেলেদের কাছ থেকে তিনি কবলাসূত্রে সম্পত্তির মালিক ও ২০০৪ সালে পাবনা জজকোর্ট থেকে তিনি ডিক্রি প্রাপ্ত হয়েছেন। খাজনা-খারিজের জন্য আবেদন করা হয়েছে। উত্তম কুমার তালুকদার আরো জানান, ১৯৭০ সালে যারা এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন, তাদের দুজনের কাছ থেকে চার আনা সম্পত্তি ক্রয় করা হয়। ১৯৭৪ সালে বাকি বারো আনা সম্পত্তি আমরা ক্রয় করি। বিজ্ঞ আদালতের দুটি ডিক্রিও আমাদের পক্ষে আছে। এসব বিষয়ে জমিদার শ্যামাচরণ রায়ের নাতি সুমন রায় বলেন, আমার দাদাদের কেই যদি ওই বাড়ির কিছু অংশ বিক্রি করে তাহলে তার কাগজপত্র দেখাতে বলেন? তাই যদি হতো তাহলে ডিএস, এসএ, আরএস রেকর্ড এ তাদের নাম থাকত। সাঁথিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনিরুজ্জামান বলেন, এ জমির বিষয়ে সরকারের আইন বিভাগকে জানানো হয়েছে। সিভিল ডিভিশনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রক্রিয়াধীন। খুব শিগগির প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেতুপাড়া গ্রামের ৩০০ বছর আগের জমিদার বাড়িটির শেষ চিহ্ন হিসেবে থাকা মন্দিরটি দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ভেঙেচুরে লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। বর্তমানে জমিদার বাড়িটি শেষ চিহ্নটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। দখলদাররা বাড়িটির প্রধান প্রবেশদ্বার ভেঙে তুলেছে দোকান ঘর। ওই নালিশী সম্পত্তিতে ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বজনের পূজা অর্চনার জন্য শিব মন্দিরের নিদর্শন এখনো দেখা যায়। যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সরকারের সংরক্ষণ করা আবশ্যক বলে প্রত্যাশা এলাকাবাসীর। তারা বলেন, প্রায় ১০ বিঘা জমির ওপর তৈরি এ জমিদার বাড়িটি উদ্ধারে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ ও প্রশাসন উদ্যোগ নিলে দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পাবে সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। লতাপাতায় ঘেরা ঐতিহাসিক জমিদারবাড়িটি পুনরায় সংস্কার করে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এটাকে পর্যটন শিল্পে রূপ দেওয়া যাবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পাবনার ক্ষেতুপাড়া,ক্ষেতুপাড়া জমিদারবাড়ি,দখল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close