এন কে বি নয়ন, ফরিদপুর

  ০১ জুন, ২০২৩

গাছি সংকটে ফরিদপুরে কমে গেছে তালের রস ও গুড় সংগ্রহ

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

ফরিদপুরে দিনে দিনে কমছে ঐতিহ্যের তালগাছ। গাছি সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই চলছে তালের রস সংগ্রহ। গাছ মালিকরা পার করছেন ব্যস্ত সময়।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ফরিদপুরের নয়টি উপজেলার প্রত্যেক ইউনিয়নে কমবেশি তালগাছ রয়েছে। এখন গাছিরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। সেই রস থেকে গুড় তৈরি করেন। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে গুড় চলে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। একসময় ফরিদপুরের সব উপজেলায় চোখে পড়তো সারি সারি তালগাছ। কিন্তু দিনে দিনে তালগাছের সংখ্যা কমছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে গাছির সংখ্যা। তালের রস নামানোর জন্য গাছি পাওয়া দুষ্কর। তালগাছ এক বীজপত্রী উদ্ভিদ। শাখা-প্রশাখাবিহীন এ গাছ ৬০ থেকে ৭০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর জীবন কাল ১০০ থেকে ১৫০ বছর। তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধ করে থাকে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তালগাছে দ্রুত উঠানামা ও রস সংগ্রহ করার জন্য গাছের সঙ্গে বাঁশ বাঁধা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও বিকেলে তিন ধাপে তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া তালগাছে মাটির হাড়ি (রসের পাত্র) পেতে রাখার সময় তালগাছের মৌচা বা খাদি সামান্য অংশ কেটে ফেলতে হয়। যে তালগাছে তাল ধরে না তাকে জটা তালগাছ বলে। সাধারণত জটাগাছ ও যে গাছে তাল ধরে সে ধরনের তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। রস সংগ্রহের পর তা দিয়ে তৈরি করা হয় গুড়।

সালথা উপজেলার বাসিন্দা আজিজুর রহমান আজিজ বলেন, একসময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি ভিটা বাড়ি থেকে শুরু করে আনাচে কানাচে, রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়তো। কালের পরিক্রমায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশ তালগাছের সংখ্যা কমছে। সালথা উপজেলায় তালগাছের অস্তিত্ব যেন অনেকটা সঙ্কটাপূর্ণ।

উপজেলার বলভদ্দি গ্রামের কৃষক সোনা মিয়া বলেন, তালের পিঠা, তালের রুটি, তালের বড়া ও তালসত্বসহ আরো অনেক রকম পিঠাও একসময় তৈরি হয়েছে আমাদের এলাকায়। মেহমানদারিতে সব পিঠা ছিল স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। আমাদের এলাকায় তালগাছ কমে গেছে। তালের গুড়ের চাহিদা থাকলেও গাছির অভাব। আগের মতো রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করা সম্ভব হয় না।

বোয়ালমারীর চতুল ইউনিয়নের বাইখির গ্রামের কৃষক মানোয়ার খান বলেন, কমতে কমতে তার এখন ২৫টি গাছ আছে। একজনকে বর্গা হিসেবে গাছ কাটার কাজ দেওয়া হয়েছে। তাল রস ও গুড়ের চাহিদা রয়েছে। ভালো দামও পাওয়া যায়। এক হাড়ি ভালো মানের রস ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। ঝোলা গুড়ের কেজি ১২০ টাকা ও এক কেজি পাটালিগুড়ের দাম ১৫০ টাকার মতো। পাইকাররা এখান থেকে গুড় কিনে নিয়ে যান।

ওই এলাকার গাছি জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে তাল গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কাজ করেন। এবার ৩০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করছেন। তাতে ২০ থেকে ২৫ হাড়ি রস হয় এবং প্রতি হাড়ি রস ১০০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করে বিক্রি করেন। এছাড়া রস থেকে উৎপাদিত গুড় ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে হাটে বিক্রি করেন। তালের ঝোলা গুড় মাটির পাত্রে রেখে সারাবছর বিক্রি করা যায়।

আলফাডাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জনশ্রুতি আছে, তালগাছে বজ্রপাত হতো। ফলে মাঠ-ঘাটে প্রাণীর জীবন রক্ষা পেত। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি হয়ে উঠছে বিরাগভাজন। বজ্রপাতে প্রাণহানি এত বেশি যে, বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। এ অবস্থায় তালগাছ রোপণ, হেফাজত ও রক্ষায় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ প্রয়োজন।

ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তালের রস একটি পুষ্টিকর পানীয়, গরমে এ রস পান করলে মানুষের মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা থাকে। মনকে সতেজ ও শান্ত রাখতে এবং ঘুম আনতে তালের রস কার্যকর।

ফরিদপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জিয়াউল হক বলেন, তালগাছ অনেক উপকারি একটি গাছ। এ গাছ রোপণ করলে বেশি জমি দখল করে না; তাই জমিও নষ্ট হয় কম। কোনো সার ওষুধ ব্যবহার করতে হয় না। কোনো পরিচর্যারও প্রয়োজন হয় না। তালগাছ রোপণের ব্যাপারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। তবে এ বিষয়ে আমাদের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। এছাড়া জেলায় কি পরিমাণ তালগাছ রয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আগের থেকে তালগাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গাছি সংকট,ফরিদপুর,তালের রস ও গুড় সংগ্রহ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close