লক্ষ্মীপুর ও দশমিনা প্রতিনিধি

  ৩১ মে, ২০২৩

অবাধে চিংড়ির রেণু আহরণ, মরছে অন্য প্রজাতি

লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে থেকে মশারি জাল দিয়ে চিংড়ির রেণু আহরণ করছেন জেলেরা। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা এবং পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরঙ্গ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট চলছে চিংড়ির রেণু পোনা আহরণ। চিংড়ির আহরণের পর অন্যান্য প্রজাতির মাছের রেণু ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে গড়ে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে হাজারো প্রজাতির দেশীয় মাছের পোনা। এসব নদ-নদীর রেণু আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও মৎস্য বিভাগ তা বন্ধে নিচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ। এতে মাছের অন্যান্য প্রজাতি যেমনি ধ্বংস হচ্ছে তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে জলজ জীববৈচিত্র্য।

ক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার লুধুয়া, পাটোয়ারীর হাট ও চর আলেকজান্ডার ঘাট ঘুরে দেখা যায়, খুঁটির সঙ্গে নিষিদ্ধ মশারি জাল ফেলে অবাধে চলছে চিংড়ি রেণু শিকারের মহোৎসব। প্রতিদিন এভাবেই জোয়ার-ভাটায় শিশু, নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সিরা দলবেঁধে নেমে পড়েন রেণু পোনা ধরতে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অপরিকল্পিতভাবে বাগদা-গলদার রেণু সংগ্রহ করছে তারা। রামগতি-কমলনগর, মতিরহাট, লুধুয়া, লক্ষ্মীপুর সদর ও রায়পুরের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩০০টি টং ঘর নির্মাণ করে হকারদের মাধ্যমে এসব নিয়ন্ত্রণ করেন প্রভাবশালীরা। এসব রেণু পোনা ড্রাম ভর্তি করে খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় বড় ঘের মালিকরা এসে কিনে নিয়ে যান। তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীরা আগেই চুক্তি করে নেন বলে জানা যায়।

স্থানীয় জেলেরা জানান, প্রতিদিন একেকজন জেলে দুই থেকে তিন হাজার রেণু সংগ্রহ করতে পারেন। প্রতিটি রেণু তাদের কাছ থেকে দুই থেকে তিন টাকা দরে কিনে নিয়ে যান মধ্যস্বত্তভোগীরা। মাঝে মাঝে মৎস্য বিভাগ ও প্রশাসনের লোক দেখানো অভিযান পরিচালিত হলেও ‘ম্যানেজের’ কারণে রেণু আহরণে অন্যান্য প্রজাতির মাছ ও জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে রয়েছে বলে মনে করছে সচেতন মহল।

তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. অমিনুল ইসলাম জানান, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে একটি সিন্ডিকেট রেণু শিকার করছে। অভিযান চালানো হচ্ছে, তবে তা কাজে আসছে না। এসব বন্ধ করতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

এদিকে, পটুয়াখালীর দশমিনার তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরঙ্গ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট চলছে চিংড়ির রেণু পোনা সংগ্রহের মহোৎসব। প্রতিদিন কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুরা মশারি জালের মাধ্যমে বাগদা চিংড়ির রেণু শিকার করছে। বিশেষ এক ধরনের সাদা চামচের পাত্র থেকে বাগদা রেণু বাছাই করে অন্য পাত্রে মজুদ করছে। এর সঙ্গে থাকা অন্য প্রজাতির রেণু ও মাছের ডিম নদীর পাড়ে ফেলে পিষিয়ে মারছে। একটি বাগদা রেণু আহরণের জন্য শত শত প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে।

জানা যায়, চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত বাগদা রেণুর মৌসুম। এ সময় প্রকৃতিগতভাবেই নদীগুলোতে উৎপন্ন হয় বাগদা চিংড়ির রেণু। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে এ পোনার বিশেষ চাহিদা থাকায় উপজেলার কয়েক হাজার জেলে এক ধরনের নিষিদ্ধ মশারি জাল নিয়ে নদীতে রেণু নিধনে কাজ করছেন। এক একটি পোনা মহাজনের কাছে বিক্রি হয় এক থেকে দুই টাকায়। মহাজন বিক্রি করছেন পাঁচ থেকে সাত টাকায়। তিন মাসের এ পেশায় অনেকটা লাভজনক হওয়ায় জেলে পরিবার ঝুঁকে পড়ছেন এ পেশায়। কে কত রেণু আহরণ করতে পারবে এ নিয়ে জেলেপাড়ায় চলছে এক ধরনের প্রতিযোগিতা।

কাটাখালী এলাকার আবু সালেক ও স্বপন হাওলাদার বলেন, প্রতিদিন ৪০০-৫০০টি বাগদা ও গলদার রেণু পোনা ধরে নদী তীরেই ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার কাছে দুই টাকা দরে বিক্রি করেন। রেণু সিন্ডিকেটের ভ্রাম্যমাণ ক্রেতারা সারা দিন নদীর তীর থেকে সব রেণু ক্রয় করে নিয়ে আসেন আউলিয়াপুর লঞ্চঘাট এলাকায়। সেখানে ভ্রাম্যমাণ ক্রেতাদের থেকে রেণু সিন্ডিকেটের পাইকাররা লাখ লাখ রেণু ক্রয় করে ড্রামে ভরে রাতে চালান করেন খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। রেণু পোনা সিন্ডিকেটের তালিকায় রয়েছেন দশমিনা সদর ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার বেল্লাল হোসেন, সৈয়দ জাফর এলাকার এসহাক হাওলাদার, মাহাবুল সরদার, রহমান হোসেন, পাতার চর এলাকার মনির রাড়ি, কাটাখালীর তাহের আকন ও সুজাত।

সাবেক ইউপি সদস্য বেল্লাল হোসেন রেণু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, বর্তমানে খুবই কম মাছ পাওয়া যাচ্ছে নদীতে। রেণু না ধরলে খাবে কি নদীর তীরের মানুষ। সৈয়দ জাফর এলাকার রেণু ব্যবসায়ী ইসহাক হাওলাদার বলেন, নদীতে মাছ কম তাই ব্যবসাও মন্দা যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, ২০-২৫ কিলোমিটার নদীপথ সব সময় নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয় না। মানুষ সচেতন না হলে রেণু নিধন বন্ধ করা কঠিন কাজ। তবে প্রায়ই নদীতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অবাধে রেণু আহরণ,মরছে অন্য প্রজাতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close