সোহেলরানা, পলাশবাড়ী (গাইবান্ধা)

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

শিক্ষার আবার বয়স কী! 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

কথায় বলে ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে সে’, জানার কোনো শেষ নেই, শিক্ষার কোন বয়স নেই। তাই অক্ষর জ্ঞানহীন যে কেউ যেকোন বয়সেই পড়ালেখা করে জ্ঞানের অন্ধকার থেকে শিক্ষার আলোর জগতে বেড়িয়ে আসতে পারেন। সম্প্রতি এলাকায় উদাহরণ সৃষ্টি করে নাতীর ছেলে পুতি কাওসারের সাথে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে নিয়মিত স্কুলে ক্লাস করছেন ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়সী বৃদ্ধ আব্দুল মান্নান। তিনি এলাকায় মান্না হিসেবে পরিচিত। আব্দুল মান্নান পেশায় একজন পানেরখিলি ব্যবসায়ী।

জানা যায়, গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ী গ্রামের প্রয়াত তছিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মান্নান। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শ্রীমুখপাড়া গ্রামে আব্দুল মান্নান জন্মগ্রহন করেন। এই জন্মস্থান বসতবাড়ীর ভিটামাটি ছেড়ে স্বপরিবার গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ী গ্রামে বসতবাড়ি গড়েন তার বাবা। অভাব অনাটনের সংসারে আব্দুল মান্নানসহ ৬ ভাই, ১ বোন ছিলেন তার বাবা-মায়ের সংসারে। ভাই বোনদের মধ্যে আব্দুল মান্নান ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মায়ের অভাব অনাটনের সংসারে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। মা-বাবাসহ ৬ ভাই, ১ বোনের সংসারে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হত তাদের। ভালো কোন খাবারও, ভাল কোন বস্ত্র ছিল না তাদের ঘরে। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাঁশের ভাত, গমের ভাত,প্যারার ছাতু, কাঁঠাল সিদ্ধ, খেসারি কালাই সিদ্ধ খেয়ে থাকতে হতো তাদের।

বাবার কোন সম্পত্তি না থাকায় সময়ের সাথে বেড়ে ওঠা আব্দুল মান্নান এর ছোট থেকেই অন্যের বাড়িতে কাজকর্ম করতে হতো। আব্দুল মান্নান ১৭ থেকে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের পর প্রায় ৫ বছর শ্রমিক হিসেবে অন্যের বাড়িতে ২ টাকা, ৩ টাকা, ১ কেজি চালের বিনিময়ে কাজ করেন। এরপর প্রায় ২৫ বছর পায়ে চালিত ভ্যানগাড়ি চালান। বয়সের ভারে এখন অনেকটাই নুঁয়ে পড়েছেন আব্দুল মান্নান। আব্দুল মান্নানের এই বৃদ্ধ বয়সে উপার্জনের অন্য কোন পথ না থাকায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে বর্তমানে স্থানীয় কাশিয়াবাড়ী বাজারে একটি পানেরখিলি বিক্রির দোকান দিয়েছেন। ওই দোকানই এখন তার একমাত্র সম্বল।

আব্দুল মান্নান এর ঘরে মালেকা ও জান্নাতী নামে ২ মেয়ে, মাফুজার নামে এক ছেলে রয়েছে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আব্দুল মান্নান এর মেয়ের ছেলে নাতীকে বিয়ে দিয়ে এখন পুতির মুখও দেখছেন। আব্দুল মান্নান এর পুতি কাওসার কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে একই বিদ্যালয়ে পুতির সাথে অক্ষর-জ্ঞানহীন আব্দুল মান্নান অক্ষর-জ্ঞান শিখতে এবং পড়তে তিনিও প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। আব্দুল মান্নানের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি রোল নম্বর-৩৭। নিয়মিত বই ও কলম হাতে করে নিয়ে বিদ্যালয়ে গিয়ে ছোট শিশু বাচ্চাদের সাথে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়সী আব্দুল মান্নান ক্লাস করছেন।

আব্দুল মান্নান বলেন , হামার জীবনে অতীতের কাহিনী বললে হামার চোখে পানি এসে যায়। অনেক দুঃখে-কষ্টে বড় হয়েছি এখন বয়সের ভারে আর কোন কাজকর্ম করতে পাইনে। বাবা-মা যখন বাঁচে আছিল তখন অভাবের কারণে পড়তে পারি নাই। জীবিকার তাগিদে এই বয়সে পানের ছোট একটা খিলি দোকান দিছি অনেক সময় বাকী যায় কিংবা বাকি টাকা যখন মানুষ দেয় তা মনে ধরে রাখতে পারিনা তাই জন্যেই স্কুলে ভর্তি হছি যাতে অক্ষর-জ্ঞান শিখে পড়তে ও লিখতে পারি। স্যারেরা অনেক ভাল, কী সুন্দর করে পড়ান ছোট বাচ্চাদের সাথে পড়ালেখা করতে হামারও ভাল নাগছে।

আবদুল হান্নান মিয়া নামে এক ব্যবসায়ী জানান, ওই মুরুব্বি অত্যন্ত সহজ-সরল ও পরহেজগার একজন মানুষ। এই বয়সে শিক্ষা গ্রহণ করতে নাতীর ছেলে পুতির সাথে স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে প্রতিদিন বই হাতে করে নিয়ে ক্লাস করছেন উনার উদ্যোগে আমরা মুগ্ধ হয়েছি।

কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান মিথুন মন্ডল জানান, আব্দুল মান্নান বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন থেকে যখন তখন অনুরোধ করে আসছে । তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে চলতি বছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি দেখিয়ে বই দেয়া হয়েছে। উনি বই হাতে করে নিয়মিত বিদ্যালয়ে এসে বাচ্চাদের সাথে মনোযোগের সহিত ক্লাস লেখাপড়া করছেন। তাছাড়া ওনার আচার-ব্যবহার খুব ভালো। ওনার ক্লাসের সহপাটিরা ওনাকে পেয়ে আনন্দের সঙ্গে পড়ালেখা করছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান নয়ন জানান, সে যেহেতু শিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, সেটা খুব ভাল কথা। উনি যদি এ বয়সে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজে বানান করে পড়তে ও লিখতে পারে তাহলে ওনারই কাজে লাগবে। এটা ওনার অত্যন্ত ভাল একটা উদ্যোগ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিক্ষার আবার বয়স কী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close