জোনাহিদ হাসান সাগর, কালীগঞ্জ (গাজীপুর)
কবুতরে ভাগ্য বদল
রুবেল সিকদার। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের পানজোরা গ্রামের আব্দুল কাদির সিকদারের ছেলে। বছর দুই আগে বেকার ছিলেন, বলা চলে। মাঝে মধ্যে কিছু কাঁচা শাক-সবজি ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করতেন। আর তা দিয়ে যা ব্যবসা হতো তাতেই স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাসহ পরিবার নিয়ে কোনো মতে দিন পার করতেন। একদিন এক বন্ধুর দাওয়াতে তার বাড়িতে বেড়াতে যান রুবেল সিকদার। সেখান থেকে বন্ধুর উপহার হিসেবে ৫ জোড়া কবুতর পান। উপহার হিসেবে পাওয়া কবুতর দিয়ে শখের বসে শুরু হয় কবুতরের খামার। সেই পাঁচ জোড়া দিয়ে শুরু করা খামারে এখন বিভিন্ন জাতের একশ জোড়া কবুতর তার। খামার সব সময় দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন দুজন প্রশিক্ষিত যুবক। এ সবই সম্ভব হয়েছে রুবেলের শ্রম ও মেধার কারণে। এখন তিনি সাবলম্ভী। কবুতরেই বদলে গেছে তার ভাগ্যের চাকা।
শীতের সকালে রুবেল সিকদারের বাড়ির তিন তলার ছাদে প্লাস্টিকের বেড়ায় বেস্টিত কবুতরের খামারের এক কোনে দাঁড়িয়ে কথা হয় তার শখের কবুতর পালন নিয়ে। রুবেল সিকদার জানান, গত দেড় বছরে মাঝখানে বড় ধরনের একটি ধাক্কা তিনি পার করেছেন। যা কাটিয়ে উঠতে তাকে কিছু বেগ পেতে হয়েছে। তার শখের খামারে বেশ কিছু কবুতর মারা যায়। সেখান থেকে তিনি তার পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তবে শখের বসে কবুতর পালন করতে গিয়ে তিনি মনে করছেন, এটা বানিজ্যিকভাবে পালন করা জরুরি। আর সেই চিন্তা মাথায় রেখে তিনি সামনে আগাচ্ছেন। তার খামারে কবুতরের পাশাপাশি দেশি জাতের মুরগী, ছাগল ও বিদেশি জাতের গাভীও রয়েছে।
তিনি জানান, শখের কবুতর খামার দেখে তার প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধব তার কাছ থেকে কবুতর নিয়ে কবুতর পালনে উদ্ধুদ্ধ হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও শখের খামারিরা তার খামার থেকে কবুতর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার তিনিও বিভিন্ন জেলা থেকে তার পছন্দ মতো কবুতর কিনে নিয়ে আসেন। রুবেলের খামারে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার ও সর্বোনিম্ন এক হাজার টাকা দামের বিভিন্ন জাতের কবুতর রয়েঝে।
খামারে সিরাজী, চিলা, রেস, বুম্বাই, মিশরীয় বুম্বাই, পাকিস্তানি কিং, মিশরীয় মেগপাই, ডায়মন্ড কিং, বিউটি কিং ও দেশিসহ বেশ কিছু জাতের কবুতর পাওয়া যাবে। সব সময় কবুতরের খামার পরিচর্চার জন্য দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা খামার দেখভাল করেন। এছাড়াও তার গরু, ছাগল ও মুরগীর খামারে আরও ছয়জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর তারা সবাই প্রশিক্ষিত।
উপজেলা প্রাণীসম্পদ বিভাগের লোকজন সব সময় খোঁজ খবর নিচ্ছেন তার খামারের। কোনো সমস্যা হলে তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেও তারা ছুটে আসেন। তাদের পরামর্শে কবুতরগুলোকে নিয়মিত টিকা দেওয়া হয়। কবুতরের খাবারের তালিকায় গম, ভূট্টা, রেজা ও সরিষা উল্লেখ্যযোগ্য।
রুবেল আরও বলেন, পাঁচ জোড়া উপহারের কবুতরের জন্য প্রথমে ৩টি ছোট খাঁচা দিয়ে শুরু করি। এরপর যখন কবুতরের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে, তখন প্রায় লাখ টাকা খরচ করে কবুতরের জন্য সেট তৈরি করি। সেখানে দেড় থেকে দু’শ কবুতর পালন করা সম্ভব। এখন খামারে প্রায় চার লাখ টাকার কবুতর রয়েছে। প্রতি মাসে কবুতরের খাবার ক্রয় করতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাগে। এছাড়া দুজন নিয়োগপ্রাপ্ত লোক তো আছেই। কবুতরের খাবার ও শ্রমিকের মজুরি বাদ দিয়ে প্রতি মাসে কবুতরের এই খামার থেকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা আয় হয়।
বেকার যুব সমাজকে উদ্দেশ্যে রুবেল সিকদার বলেন, বেকার বা অলস থাকা একদমই ঠিক নয়। কারো ইচ্ছা শক্তি থাকলে ছোট থেকেই শুরু করা যায়। আপনারা দুই জোড়া দিয়ে শুরু করেন, দেখবেন এক বছরের মধ্যে আপনি আপনার পরিশ্রম দিয়ে এর সুফল পাবেন। আমি এক সময় বেকার ছিলাম। কিন্তু মাত্র পাঁচ জোড়া দিয়ে শুরু করে আজকে আমি লাভবান এবং এটা লাভজনকও বটে। বর্তমান সরকার বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করছেন এবং সহজ সুদে ঋণ দিচ্ছেন।
প্রতিবেশী শাহ আলম সিকদার (৩৯) বলেন, আমারই প্রতিবেশী ছোট ভাই রুবেল সিকদার কবুতরের খামার করেছে। সেখানে এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ৬ মাস ধরে কাজ করছি। এখানে বেশ ভালো বেতন পাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ, এই খামারের বেতন দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই চলছে।
রুবেল সিকদারের কবুতরের খামারের কর্মচারী আরেক যুবক নাসির উদ্দিন পিন্টু (৪০) বলেন, আমার বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। প্রায় বছর খানেক ধরে রুবেল ভাইয়ের কবুতরের খামারে কাজ করছি। কবুতরের পাশাপাশি গরুর খামারও দেখাশোনা করছি। বেতনও পাচ্ছি ভালো। স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মা নিয়ে ভালোভাবেই সংসার চলছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ হাবিব বলেন, রুবেল সিকদার একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি পাঁচ জোড়া কবুতর নিয়ে শুরু করে তার খামারে এখন একশ জোড়ার উপরে কবুতর। তাকে দেখে আশপাশের অনেক বেকার যুবকরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ওনি আমাদের কাছে যখনি কোনো সমস্যা নিয়ে যোগাযোগ করেন, আমরা তা সমাধানের চেষ্টা করি। এছাড়াও কবুতরের টিকা দেওয়ার প্রয়োজন হলে আমাদের কাছে পরামর্শের জন্য আসলে আমরা পরামর্শ দিয়ে দেই। যদি কোনো ক্ষেত্রে টিকা প্রদাণকারীর সংকট হয়, তবে টিকা কীভাবে দিতে হয়, সেই প্রশিক্ষণ দিয়ে দেই। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা আমাদের লোক দিয়েও সেই টিকার ব্যবস্থা করে থাকি। তাছাড়া কবুতরের রোগ-বালাই নিয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে থাকি।
পিডিএস/এস/এইচএস