কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ২৯ নভেম্বর, ২০২২

প্রধানমন্ত্রীকে বরণের জন্য উদগ্রীব চট্টগ্রামবাসী

ফাইল ছবি

সময়টা ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর। জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ২৫ মিনিট বক্তব্য রেখেছিলেন। এরপর তিনি আসেন ২০১২ সালের ২৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর জনসভায় ভাষণ দিতে চট্টগ্রাম আসছেন। তবে তিনি তার মূল্যবান কথাগুলো বলেছিলেন ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে। এ সময় নির্বাচনের আগে তিনি দিয়েছিলেন নানা প্রতিশ্রুতি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবার তিনি ১৪ বছর আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখবেন। প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে এরই মধ্যে প্রস্তুত চট্টগ্রাম। তার আগমন ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামবাসী এখন ৪ ডিসেম্বরের অপেক্ষায়।

প্রায় ১৪ বছর আগে চট্টগ্রাম ছিল অবহেলিত এক জনপদ। একের পর এক সরকার এলেও চট্টগ্রামের দিকে নজর দেয়নি কেউ। শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছিল। সাবেক বিএনপি সরকারের আমলে চট্টগ্রামকে ঘিরে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখান বিএনপি নেতারা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামবাসী শুধু ধোঁকাই খেয়েছে। উন্নয়ন তো দূরের কথা, বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে প্রায় প্রতিদিন ছিল মানুষের মিছিল। চট্টগ্রামের মানুষ বিএনপি নেতাদের কথা বিশ^াস করে আসনও কম দেননি। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতাদের মধ্যে প্রভাবশালী মন্ত্রীও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু নিজেদের উন্নতি হলেও চট্টগ্রামের উন্নয়ন হয়নি। তাই মানুষ ছিল হতাশ। এরই মধ্যে ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা লালদীঘির জনসভায় চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। এ সময় বিশাল জনসমুদ্রে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘গত জোট সরকার আমলে দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে চট্টগ্রামের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আজ থেকে চট্টগ্রামের সব উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজে নিয়েছি। মহাজোট ক্ষমতায় গেলে চট্টগ্রাম হবে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন, পানি সমস্যার সমাধান, কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণসহ চট্টগ্রামকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই করা হবে। আপনার ভোট দিয়ে মহাজোটকে জয়যুক্ত করুন।’

শেখ হাসিনা যখন ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর বক্তব্য রাখছিলেন তখন চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থা ছিল আসলেই করুণ। কারণ এর আগের জোট সরকারের আমলের বছরগুলোতে আশানুরূপ কোনো বিনিয়োগ হয়নি চট্টগ্রামে। একে একে চট্টগ্রাম থেকে চলে গেছে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি। মূলত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও প্রশাসনিকসহ অবকাঠামোগত নানা সুযোগ-সুবিধার অভাবে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পেছনে পড়ে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বছরের পর বছর মন্ত্রণালয়ে ফাইল নিয়ে ঘোরাঘুরি করেও কোনো সুরাহা করতে পারেননি। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের ফলে সত্তর দশকের শেষার্ধ্বে ও আশির দশকে দেশে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পোদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটেছিল চট্টগ্রামে। যারা মাঝারি আকারের অনেক রপ্তানিমুখী শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের উন্নয়নের পর আরো একধাপ এগিয়ে যায় চট্টগ্রাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই চট্টগ্রামের সব অর্জন নষ্ট হতে থাকে।

চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হতো গ্রিডলাইনে। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ১০০০ মেগাওয়াটের মতো। প্রয়োজন ৫০০ মেগাওয়াট হলেও বিদ্যুৎ মিলত ২০০ মেগাওয়াটেরও নিচে। চহিদার তুলনায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও চট্টগ্রামবাসী বিদ্যুতের আলো পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল। একই অবস্থা ছিল পানির ক্ষেত্রেও। চট্টগ্রাম ওয়াসায় ২২ বছরে একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি বরাদ্দের ক্ষেত্রেও চট্টগ্রামের প্রতি বৈষম্য ছিল নজরে পড়ার মতো। করপোরেশন থেকে প্রতি বছর শতকোটি টাকা চাওয়া হলেও বরাদ্দ আসতো মাত্র ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। স্থানীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা খুবই সীমিত। এ অবস্থায় নগরবাসী বাণিজ্যিক রাজধানীর ঘোষণাটিকে স্রেফ একটি আইওয়াশ বলে ধরে নেয়। বিএনপি সরকারের ওপর থেকে ক্রমশ কমতে থাকে মানুষের আস্থা।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়নের দায়িত্ব তিনি আজ থেকে নিজের হাতে নিয়েছেন। প্রায় ১৪ বছর পর চট্টগ্রামবাসী দেখলেন, তিনি তার প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এসে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কথা জানান। এ সময় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা দিয়েছেন। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কারণে এত দিন বাস্তবায়িত না হলেও বর্তমানে সরকার চট্টগ্রামকে সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মতে ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের উন্নয়নের পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যেতে শুরু করে। করোনার সময়েও থেমে থাকেনি চট্টগ্রামের উন্নয়ন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মান ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বঙ্গবন্ধু টানেল ও ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৭ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজও শেষের পথে। আর বড় বড় এ প্রকল্পগুলোর কাজ সমানতালে চলছে। কয়েক বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের চেহারা অনেকাংশে পাল্টাতে থাকে। বিদ্যুৎ সমস্যা নেই। চট্টগ্রামে পানির জন্য হাহাকার নেই। পানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ এখন চট্টগ্রাম। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছে সেনাবাহিনী। চট্টগ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থপনা ও কর্ণফুলী নদী দখল-দূষণমুক্ত করতেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের কাজ পুরোদমে চলছে। দেশি-বিদেশি অনেক কোম্পানি এরই মধ্যে এখানে তাদের কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লাখো লোকের কর্মসংস্থান হবে এখানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিজিএমইএ গার্মেন্ট পার্ক ও পিপিপি জোন এবং ৭২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২০ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার এবং সম্ভাব্য কর্মসংস্থান (বিজিএমইএ গার্মেন্ট পার্ক, বেপজা ও এসবিজি ইকোনমিক জোন) প্রায় ১০ লাখ। শুরু হয়েছে বহু আকাক্সিক্ষত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের কাজ। মহেশখালীর সমুদ্র অঞ্চলে শুরু হয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলটি হবে আরেকটি সিঙ্গাপুর। পার্বত্য এলাকার ভেতরে চলাচলের রাস্তা এখন মসৃণ হচ্ছে। এক সময়ের দুর্গম অঞ্চল বলে ভাবা সেসব অঞ্চলে এখন লেগে আছে পর্যটকদের ভিড়। দ্রুতই যেন বদলাচ্ছে সবকিছু।

কাগজে-কলমে নয় এবার বাস্তবিক অর্থেই চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করা হচ্ছে দেখে অনেক আশাবাদী চট্টগ্রামের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কথা রাখায় চট্টগ্রামবাসীও কৃতজ্ঞতা জানাতে প্রস্তুত। আগামী ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করার জন্য এখন উন্মুখ চট্টগ্রামবাসী।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রধানমন্ত্রী,শেখ হাসিনা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close