আলী আজীম, মোংলা (বাগেরহাট)

  ২৫ নভেম্বর, ২০২২

পাখির জন্য ভালোবাসা 

গাছে গাছে হাঁড়ি বসিয়ে পাখিদের নিরাপদ বাসার ব্যবস্থা করছে এক পাখিপ্রেমী। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

বেলা গড়িয়ে বিকাল, এরপর সন্ধ্যা। এই সময়টা নীড়ে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায় চারপাশ। পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত স্থানটি হলো মোংলা পৌর শহরের শেখ আবদুল হাই সড়ক। শহরের ভেতরেই সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা এই সবুজ শ্যামল পরিবেশ। এখানে তরুণরা পাখির বন্ধু। তারা গাছে গাছে হাঁড়ি বসিয়ে পাখিদের নিরাপদ বাসার ব্যবস্থা করেছে। তাদের রয়েছে পাখির জন্য ভালোবাসা।

মোংলায় গাছে হাড়ি বেঁধে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছেন একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পাঁচফোড়ন শিল্প পরিবার’। প্রতিদিন শহরের শত শত দর্শনার্থী আসেন এই পাখি আর প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। আনন্দ পেতে। অভয়াশ্রমে পানি-খাবার সরবরাহ করে পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাস্থল গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের এই ব্যতিক্রম উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

চারদিকে নগরায়ণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তাই পাখি রক্ষায় এই ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পাঁচফোড়ন শিল্প পরিবার’। মোংলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার তরুণরামিলে ‘গাছের জন্য পাখি নয়, পাখির জন্য গাছ’ স্লোগানে গড়ে তোলেন এই পাঁচফোড়ন শিল্প পরিবার।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দেশীয় পাখির নিরাপদ কৃত্রিম আবাস তৈরি, পাখি, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে যাচ্ছেন তারা। গাছে পাখি ফিরাতে সড়ক বিভাজকে থাকা গাছগুলোতে কৃত্রিম পাখির বাসা, পানির পাত্র স্থাপন করে পানি ও খাবারের ব্যাবস্থা করছেন তারা।

২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। এরপর ২৫ মার্চ মঞ্চ নাটক প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় তাদের। বর্তমানে তাদের সদস্য সংখ্যা ২০ জন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাঁচফোড়ন শিল্প পরিবারের পরিচালক জ্যোতি হালদার বলেন, আমাদের সন্তানরা পাখি দেখে না। গাছের মধ্যে আমরা পাখির আবাসস্থল গড়ে তুলতে পারি। তাহলে আমরা অন্তত পাখির ডাক শুনতে পাবো। নতুন প্রজন্মকে পাখি ও প্রকৃতি প্রেমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেই আমাদের এমন উদ্যোগ। পাখিদের আশ্রয় দিতে পৌর শহরের গাছগুলোর নিরাপদ ডালে ওঠে মাটির হাঁড়ি বেঁধে দিয়ে পাখির বাসা তৈরি করে দিয়েছেন তারা। এরই মধ্যে অনেক পাখি আশ্রয় নিয়েছে এ হাঁড়িতে। পাখিরা বসছে, খেলা করছে, কিচিরমিচির করছে।

সংগঠনের উপপরিচালক সাগর হালদার বলেন, ‘পাখিদের নিরাপদে আশ্রয় দেওয়ার সতর্কতায় পাখি শিকার, বিক্রি ও হত্যা বন্ধে সচেতনতামূলক প্রচার করছি। এ কাজে কেউ গাছের নিচ থেকে মই ধরেছিল, আবার কেউ মই বেয়ে গাছের মগডালে ওঠে শক্ত রশি দিয়ে হাঁড়ি বেঁধেছে। আনন্দ নিয়েই কাজটি করছি আমরা।

সংগঠনটির আরেক উপপরিচালক নয়ন বলেন, ‘আমি নিজেই গাছে ওঠে গাছের ডালে শক্ত করে হাঁড়ি বেঁধে দিয়েছি। এ সময় আমার এক বন্ধু মই ধরে নিচে দাঁড়িয়েছিল। কাজটি করতে বেশ ভালো লেগেছে। তিনি আরো বলেন, ‘পাখিরা গাছে আশ্রয় নেয়, গাছেই ডিম পাড়ে ও বাচ্চা ফোটায়। তা ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে গাছে আশ্রিত পাখির ক্ষতি হয়ে থাকে। নিরাপদ আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে প্রকৃতিতে পশু-পাখির সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। এসব দিক বিবেচনা করে পাখির জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এ কাজটি করেছি আমরা।

পাঁচফোড়ন শিল্প পরিবার পরিচালক শেখ মেহেদী হাসান জিকু বলেন, ‘বড় বড় গাছে মাটির হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মাটির হাঁড়িগুলোর ওপরের অংশ খোলা। এসব হাঁড়িতে বাসা তৈরি করবে পাখিগুলো। সেখানেই ডিম দিবে এবং বাচ্চা ফুটাবে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে পাখিরা হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল। এছাড়া পাখি প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ ভাবনা থেকেই পাখির জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি ও তাদের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিত করতে সংগঠনটি গাছে গাছে পাখির বাসা হিসেবে মাটির হাঁড়ি বাঁধার এ উদ্যোগ।

তাদের এমন উদ্যোগে অন্য পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমীরাও এগিয়ে আসবে পরিবেশ রক্ষায় বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বাগেরহাট জেলা আহ্বায়ক সাংবাদিক নুর আলম শেখ বলেন, পরিবেশ সুরক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরসীম। তাই মানুষকে পাখি সুরক্ষায় সচেতন করতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পাখিকে নিরাপদ আবাসস্থল দিতে হবে। বাড়াতে হবে তাদের বংশবিস্তার। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে মোংলায় পাখিদের নিরাপদ বাসা ও বংশবিস্তার করার জন্য শুরু হয়েছে গাছে গাছে হাঁড়ি বাঁধা। যেখানে তারা নির্ভয়ে বসবাস করতে পারবে। পাখিবান্ধব পরিবেশ তৈরি করলে নগরায়ণও হবে, পরিবেশও সুন্দর হবে। এর সঙ্গে মানুষ ও পাখির সহাবস্থান নিশ্চিত হবে। সংগঠনের সদস্যরা সুন্দরভাবে পরিবেশের উন্নয়নমূলক কাজগুলো করে থাকে। আমি মনে করি, আমাদের এলাকার সবার উচিত সংগঠনের কাজে সহযোগিতা করা। এখানে অনেক বিরল প্রজাতির পাখি রয়েছে। এমন একটি উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আমি সংগঠনটির সাফল্য কামনা করছি।

বাপা নেতা সাংবাদিক হাছিব সরদার বলেন, বিকালে পাখির কিচিরমিচির ডাক যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ থাকায় পাখিরা এখানে ছুটে আসে। নিরাপদে থাকতে পারে। আমরা পাখির ডাক শোনার জন্য এখানে আসি। সত্যিই খুব ভালো লাগে। শহরের নানা যানবাহনের শব্দের মাঝে পাখির ছোটাছুটি সত্যিই অসাধারণ দৃশ্য। পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ ছাড়াও সংগঠনটি কিছু সামাজিক কাজ করছে।

আর নতুন প্রজন্মের মধ্যে পাখি প্রেম ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে এমনটাই প্রত্যাশা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পাঁচফোড়ন শিল্প পরিবার’-এর। মোংলা পোর্ট পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুর রহমান বলেন, এখানে অনেক গাছ রয়েছে। এসব গাছ রক্ষণাবেক্ষণ আমরা মোংলা পোর্ট পৌরসভার পক্ষ থেকে করে থাকি। এখানে গাছ-গাছালি থাকায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বসবাস করে। পাখির নিরাপদ আশ্রয় এই গাছ। এখানে সব ধরনের পাখি শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পাখির জন্য ভালোবাসা,পাখি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close