অলিউজ্জামান রুবেল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
চাঁপাইয়ে নড়বড়ে বিএনপি : তিন নেতার গ্রুপিং
মাঠের রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নেই। সাংগঠনিক অবস্থাও নড়বড়ে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিএনপিতে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে বিদ্রোহ, পদত্যাগ, শোকজ আর বহিষ্কারের ঘটনা। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক আর সদস্য সচিব- এই তিন নেতা এখন দুই গ্রুপে বিভক্ত। দেশে রাজনীতির এই সময়েও চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিএনপিতে চলছে গ্রুপিং আর দ্বন্দ্ব। ইউনিট কমিটিগুলোতে চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা। এসব কারণে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে বিএনপি। চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়েই এখন আলোচিত হচ্ছে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি। যেখানে জনসমর্থনের দিক দিয়ে এ দলটি অনেক এগিয়ে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে অসন্তোষ থেকে আহ্বায়ক ওবায়েদ পাঠানকে বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটি দাবি করেছেন। ৩১ সদস্যের মধ্যে সদস্য সচিবসহ ২৩ নেতাই ওবায়েদ পাঠানকে বাদ দেওয়ার পক্ষে। এরা সবাই জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়ার অনুসারী। এদিকে ওবায়েদ পাঠানকে বাদ না দিয়ে আহ্বায়ক পদে বহাল রেখে ১৫ অক্টোবর নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম টিপু ও সদস্য সচিব মো. রফিকুল ইসলাম এ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন। শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কমিটি নিয়েও চলছে অসন্তোষ। সেখানেও কয়েক দফায় উপজেলা ও পৌর কমিটির অধিকাংশই নেতা পদত্যাগ করেছেন। ভোলাহাট উপজেলাতেও কমিটি থাকতে আরেক কমিটি দিয়েছেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব। এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে বিএনপি নিয়ে।
এই অবস্থায় স্থানীয় বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। সেখান থেকে আলোচনা হচ্ছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিএনপিতে এখন ‘তিন নেতার দুই গ্রুপ’। ফলে দুর্বল হচ্ছে বিএনপির ঘাঁটি এ জেলাটি। নতুন কমিটি ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। উল্টো বলয় বেড়েছে, বলয়ের ভেতরে তৈরি হয় উপবলয়ে অন্তঃস্রোত। ফলে দ্বন্দ্ব, রেষারেষি বেড়েছে।
শিবগঞ্জ বিএনপির একাধিক নেতা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া। দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন কমিটির বেশির ভাগ নেতা তার বলয়ের। সেখানে আরেক বলয় তৈরির চেষ্টা করেছেন রাজশাহী বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহিন শওকত। বেশ কয়েকজন নেতা শাহিন শওকতের পেছনেও আছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ সদর আসনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশিদ। বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ আমিনুল ইসলাম হারুনুর রশিদের সঙ্গে রয়েছেন।
দলীয় সূত্র বলছে, জেলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ তিন নেতার মতামত না নিয়েই দেওয়া হয়েছে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। এই পরিস্থিতে নবগঠিত নেতৃত্বের কাছে জেলার ইউনিট কমিটিগুলো ঢেলে সাজানো সহজ হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলছেনÑ প্রভাবশালী নেতারা এ কমিটিকে সহযোগিতা নয়, বাধা সৃষ্টি করবেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির পাঁচটি উপজেলা, চার পৌরসভা ও ৪৫টি ইউনিয়ন রয়েছে। সাংগঠনিক এসব ইউনিটগুলোর অবস্থা খুবই নাজেহাল।
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম জাকারিয়াকে আহ্বায়ক ও মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে ৩ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। এতে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম টিপুকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৫১ সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেখানে সাবেক সংসদ সদস্য ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. হারুনুর রশিদ ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম এমপির অনুসারীদের কমিটিতে রাখা হয়নি।
এদিকে চলতি বছরের মে মাসে কমিটি গঠনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিসহ সদর, নাচোল ও ভোলাহাট উপজেলা কমিটি থেকে ৬০ নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া লিখিত বক্তব্যকে ‘তারেক রহমানের উদ্দেশে খোলা চিঠি’ হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।
লিখিত বক্তব্যে নাচোল বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক বলেছিলেনÑ দীর্ঘ দুই যুগ থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যাদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই, বিগত ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের বিপক্ষে, জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এদের কারো কারো দলের প্রাথমিক সদস্য পদও নেই।
বিএনপি নেতা জনাব আলী বললেন, সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ওবায়েদ পাঠানকে বাদ দিয়ে নতুন করে কামিটি দাবি করেছিলাম। ৩১ সদস্যের মধ্যে সদস্য সচিবসহ আমরা ২৩ নেতা আহ্বায়কের প্রতি অনাস্থা এনে এ দাবি করেছিলেন। দেখলাম আহ্বায়ককে বহাল রেখে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় আছি, থাকব। তবে স্থানীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘২০-২৫ বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামের পক্ষে যারা ভোট করেছেন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন তারা। এছাড়া উপজেলা আহ্বায়ক কমিটিগুলোতেও সঠিক লোকদের মনোনীত করা হয়নি। যারা এসব কমিটি গঠনের সঙ্গে জড়িত, তারা দায়িত্বশীল আচরণ করেননি। দলের জন্য এটা ক্ষতিকর হয়েছে। আমি চাইব, এসব কমিটি বাতিল করে নতুনভাবে যোগ্য লোকদের নিয়ে যেন কমিটি গঠন করা হয়।
জানতে চাইলে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া বলেন, ইউনিট কমিটিগুলো গঠনে কিছু ত্রুটি ছিল। অধিকাংশ কমিটিতে পরিবর্তন আসছে। যারা দলের ত্যাগী তাদের মূল্যায়ন করা হবে। আশা করছি শিগগিরই সব সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে বিএনপি। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।