সেলিম রানা, ফুলপুর (ময়মনসিংহ)

  ০৭ অক্টোবর, ২০২২

অনিয়ম ও দৈন্যদশায় ফুলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

ফাইল ছবি

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নানা অনিয়ম ও দৈন্যদশায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অভাবে প্রতিদিন শত শত রোগী সঠিক চিকিৎসা নিতে পারছেন না। চিকিৎসকের ৩০টি পদের ৭টিই শূন্য। কর্মরত ২৩ চিকিৎসকের মধ্যে মাতৃত্ব ছুটিতে আছেন একজন, প্রেষণে অন্যত্র দায়িত্ব পালন করছেন একজন। মোট ৯ চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকছেন।

রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তার ও দালালদের নির্দেশিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা না করালে তারা ক্ষিপ্ত হন এবং রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত টেস্ট দেন বলে জানান তারা। এ ছাড়া কমিউনিটি ভিশন সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফরোজা আক্তার ও মর্জিনা খাতুন নামে দুজন সিনিয়র স্টাফ নার্স রয়েছেন। তারা রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) চোখের চিকিৎসা নিতে আসেন বালিয়া গ্রামের ইমান আলী (৬৫)। তাকে কিলজেন নামে একটি আইড্রপ লিখে দিয়ে বাইরে থেকে কিনতে বলা হয়।

জানা গেছে, ফুলপুর হাসপাতালে জুলাই ২০২১ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত ৫ কিস্তিতে মোট ১ কোটি ৪২ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩২ টাকার ওষুধ সরকারিভাবে আসে। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে টেন্ডারের মাধ্যমে ৩২ লাখ ৭৯ হাজার ৫৭৫ টাকার ওষুধ আসে বলে অফিস সূত্রে জানা যায়। কাগজপত্রে প্রায় ২ কোটি টাকার ওষুধ এলেও হাসপাতালে দামি ওষুধ পাওয়া না।

ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিনে দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ডের বাথরুমের দরজা নেই। পানি সাপ্লাই থাকলেও অতিরিক্ত আয়রনের কারণে তা ব্যবহারের অযোগ্য। শিশু ওয়ার্ডে হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা নেই। বিহারাঙ্গা গ্রামের গৃহবধূ তানিয়া আক্তার বলেন, তিনি দুই দিন যাবৎ শিশুসন্তান নিয়ে ভর্তি আছেন। হাসপাতাল থেকে শুধু ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা পাওয়া গেছে। সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। চরবাহাদুরপুর গ্রামের সাবিনা খাতুন (৪০) জানান, হাসপাতালে কম দামের কিছু ওষুধ পাওয়া যায়।

জানা গেছে, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা তাদের ওষুধ প্রেসক্রাইব করার জন্য ডাক্তারদের প্রতি মাসে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা সম্মানী দিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ডাক্তাররা প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে চুক্তিমাফিক মাস শেষে কমিশনের টাকা একত্রে পেয়ে থাকেন। হাসপাতালে ইনজুরি সার্টিফিকেটেরও রমরমা ব্যবসা চলছে। মামলার গুরুত্ব বাড়াতে সাধারণ আঘাতের স্থলে গুরুতর আঘাতের সার্টিফিকেট ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয় বলে গোপন সূত্রে জানা যায়।

ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিসিন, গাইনি ও প্যাথলজি বিভাগ রয়েছে। হাসপাতালে ২টি এক্স-রে মেশিন থাকলেও বিকল পড়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে হাসপাতালের একমাত্র আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন।

ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন মহাসড়কের পাশে রয়েছে বহু অনুমোদনহীন প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোনো কোনো মালিক ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করেন। একটি সংঘবদ্ধ দালালচক্র রোগীদের টেনে নিয়ে যায় ওইসব প্যাথলজিতে। প্যাথলজি থেকে কমিশনের লোভে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তাররা অতিরিক্ত টেস্টের পরামর্শ দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শীতেষ চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে লাইসেন্স না থাকার কারণে নেক্সাস ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ১৫ হাজার টাকা, লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২০ হাজার টাকা জরিমানাসহ সিলগালা করা হয়।

হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়কে স্পিড ব্রেকার বা জেব্রা ক্রসিং নেই। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতাল গেটের সামনে মহাসড়কে স্পিড ব্রেকার বা জেব্রা ক্রসিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

হাসপাতালে জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নিজস্ব জেনারেটর থাকলেও ডিজেল বরাদ্দ না থাকায় প্রায় ২০ বছর যাবৎ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলে মোমবাতি দিয়ে কাজ চালানো হয়। এমনকি অপারেশন থিয়েটারে মোমবাতি জ্বালিয়ে চলে অপারেশন, ডেলিভারি এবং সেলাইয়ের কাজ।

হাসপাতালে ওয়াশিং পাউডার, হারপিক ও ব্লিচিং কেনা বাবদ সরকারি বরাদ্দের মাসিক প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা কোথায় ব্যয় হয় তা কেউ জানে না। হাসপাতালে সরকারিভাবে ৪ জন চুক্তিভিত্তিক ৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকলেও অধিকাংশ জায়গা অপরিষ্কার থাকে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৭ জন। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয় ২৫ হাজার ৬৭৭ জন। ভর্তি হয়ে সেবা নেয় ১১ হাজার ১৭৫ জন রোগী। শয্যা সীমিত থাকায় জটিল রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীই ভর্তির সুযোগ পায় না। কখনো কখনো শয্যা খালি থাকলেও ডাক্তাররা বাড়তি ঝামেলা মনে করে এসব রোগীকে রেফার্ড করে দেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অর্থের অভাবে হতদরিদ্র অনেক রোগীই ময়মনসিংহে গিয়ে সেবা নিতে পারেন না।

বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে ফুলপুর হাসপাতালের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জায়েদ মাহবুব খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, টাকার বিনিময়ে ইনজুরি সার্টিফিকেটের অভিযোগটি অসত্য। ফুলপুর হাসপাতালে কোনো দালাল থাকার বিষয়টিও তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। হাসপাতালে একমাত্র আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি নষ্ট থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। এ ছাড়া উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ সংযোগ ও রেডিওলজিস্ট না থাকায় এক্স-রে মেশিনগুলো চালানো যাচ্ছে না বলে তিনি জানান।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ফুলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close