কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম
নতুন বন্দর ‘বে টার্মিনাল’ নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু
চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে নতুন আর একটি বন্দর নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন এ বন্দরের নাম ‘বে টার্মিনাল’। ১১০ কোটি টাকায় নিয়োগ করা হয়েছে কনসালট্যান্ট। দক্ষিণ কোরিয় কোম্পানি ‘কুনহুয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড ও ডিওয়াই ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি’ এরই মধ্যে তাদের পরিকল্পনা বন্দরের বরাবরে পেশ করেছে।
কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, বন্দর টার্মিনাল নির্মাণের জন্য বন্দর সংশ্লিষ্ট সকলের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাতে কোন কিছু যুক্ত হবে কিনা তার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মতামত চেয়েছে। বিনামূল্যে ভূমি বরাদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ। অনুমোদন পাবার সাথে সাথে পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যাবে।
চট্টগ্রামে নতুন একটি বে টার্মিনাল নির্মাণের বিষয় নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা চাইছেন দ্রুত কাজ শুরু হোক। কিন্ত নানা জটিলতায় এরই মধ্যে চলে গেছে ১০ বছরেরও বেশি সময়। বিশেষ করে ভূমি জটিলতার কারণে প্রকল্পটি নিয়ে আগানো যাচ্ছিল না। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ আশা করছে শিগিরিই এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেবেন। ডিসেম্বরের মধ্যে ভূমি বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, চট্টগ্রাম বে-টার্মিনালের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। এখানে ১৩টি জেটি থাকবে। আরো থাকবে তিনটি টার্মিনাল। এটি পরিচালনা করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা করবে বিশ্বের শীর্ষ বন্দর পরিচালনাকারীরা। ভূমি বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসনের কাছে জমি চেয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে গত বছরের অক্টোবর মাসে ৬৮ একর জমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে ৪শ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।
এ বন্দরের রূপরেখা কি রকম হবে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বে-টার্মিনাল প্রকল্পে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করবে। বাকি দুটি টার্মিনাল পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয়া হবে। বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ আগামী ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশাল আকারের এ বন্দরটি নির্মাণ হলে দেশের ভাবমূর্তি অনেক বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ যে গতিতে চলছে তাতে বে টার্মিনাল নির্মাণের কোন বিকল্প নেই। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে বন্দর কর্তৃপক্ষ এটি নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তবে ‘বে টার্মিনাল’ নির্মাণের জন্য শুধু ভূমি কিনতে ব্যয় হবে প্রায় ৩ হাজার ৬শ কোটি টাকা। এত বিশাল পরিমান টাকা দেয়া বন্দরের পক্ষে সম্ভব নয়। জমির পরিমান প্রায় ৮০৩ একর। তবে আশার কথা যে সব ভূমিতে এ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তাতে ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি কম। বিষয়টি এরই মধ্যে সমাধান হয়েছে। বাকি ভূমি সাগরে জেগে উঠা চর। যে ভূমির মূল্য ৩ হাজার ৬শ কোটি টাকা। বন্দর কর্তৃপক্ষ নূন্যতম এক টাকায় এ জমি চেয়েছে সরকারের কাছে। প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে কাজ শুরু হবে।
সূত্র জানায়, বে টার্মিনাল মূলত তিন ধাপে নির্মাণ হবে। এরই মধ্যে এ মেগা প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের অন্যান্য সেবা সংস্থার মতামতের জন্য পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে কন্টেনার জাহাজ প্রবেশ ও বের হওয়ার ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা লেগে থাকে। তবে বে টার্মিনালে এগুলো থাকবে না। এটি এমনভাবে তৈরি হবে যাতে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জাহাজ ভীড়তে এবং পণ্য নিয়ে চলে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি ক্রমশ বাড়ছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার টিইইউএস কন্টেনার পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ হার ৫ শতাংশ বেশি। এ হার বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সিঙ্গাপুর, কলম্বো বন্দরে ভয়াবহ কন্টেনার জটেও ২৪ ঘণ্টা সচল ছিল বন্দর। তবে ভবিষ্যতে ট্রানজিট ও অন্যান্য কারণে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের মাত্রা আরও বাড়লে বন্দরকে চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হবে। এ অবস্থায় দ্রুত বে টার্মিনাল নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশে কন্টেনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশই আনা নেয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।