‘মরিয়মের মা রহিমা বেগম জানালেন তাকে অপহরণ করা হয়েছিল’
নিখোঁজের ২৯ দিন পর ফরিদপুর থেকে উদ্ধার হওয়া রহিমা বেগম পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে মুখ খুলেছেন। রহিমা বেগমের দাবি, গত ২৭ আগস্ট রাতে পানি আনতে গিয়ে তিনি অপহৃত হন। চার ব্যক্তি তাকে জাপটে ধরে নাকে রুমাল চেপে ধরেন। এতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তার কিছু মনে নেই।
রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান এ তথ্য জানান।
পুলিশ সুপার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রহিমা বেগম অপহৃত হয়েছেন বলেই দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, তাকে চারজন মিলে অপহরণ করে নিয়ে যান। কিন্তু তারা কারা বা কোথায় নিয়ে যান, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারেননি। একপর্যায়ে তারা সাদা (খালি) স্ট্যাম্পে কিছু স্বাক্ষর নেন। স্বাক্ষর নেওয়ার পর তাকে একটা নির্জন জায়গায় ছেড়ে দেন। কিন্তু জায়গাটা কোথায় সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। এরপর তিনি মনি নামের একটি মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। তবে সেই মেয়ের বাড়ি কোথায় তিনি বলতে পারছেন না। এরপর ওই মেয়ে তাকে এক হাজার টাকা সংগ্রহ করে দেন। পরে তিনি মকসুদপুরে চলে আসেন।
সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, যখন যেখানে ছিলেন, তারা তাকে কাপড়চোপড় দিয়েছেন বলে জানান রহিমা। সেগুলো তিনি সংগ্রহে রেখেছিলেন। মুকসুদপুর থেকে তিনি বোয়ালমারীতে আসেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর তার বাড়ির ২৮ বছর আগের ভাড়াটিয়া আবদুস কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে যান। কুদ্দুস একসময় খুলনার দৌলতপুরের সোনালী জুট মিলে চাকরি করতেন। তিনি ভেবেছিলেন, সেখানে গেলে আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে।
খুলনায় না গিয়ে ফরিদপুরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রহিমা বেগম পুলিশকে জানান, খুলনায় আসতে ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কুদ্দুসের বাড়ি যাওয়ার পর মেয়েদের খবর দেবেন। এরপর মেয়েদের সঙ্গে চলে যাবেন।
সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান, সৈয়দপুরে অবস্থানকালে ঘটনাটি আলোচিত হলে ওই এলাকার একটি ছেলে বিষয়টি স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির নজরে আনেন। ওই জনপ্রতিনিধি বিষয়টি খুলনার দৌলতপুরের এক কাউন্সিলরকে জানান। তিনি ঘটনাটি দৌলতপুর থানা-পুলিশকে জানান। এরপর দৌলতপুর থানার পুলিশ গতকাল শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
পুলিশ সুপার জানান, রহিমা বেগমকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতে তিনি জবানবন্দি দেবেন। এরপর আদালতের সিদ্ধান্ত মতো কার্যক্রম চলবে।
গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা বেগম। এর পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণ মামলা করেন। এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মায়ের সন্ধান চেয়ে ঢাকায় মানববন্ধনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ করে আসছিলেন তার সন্তানেরা।
এর আগে সকালে রহিমা বেগমকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে নেওয়ার সময় দৌলতপুর থানার উপপরিদর্শক দোলা দে বলেন, রহিমা বেগম তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি সন্তান ও স্বামীর কাছে যেতে চান না। তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান সকালে দেখা করতে এলেও দেখা করতে চাননি রহিমা। পরে দেখা বলেও রহিমা বেগম তার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
২৯ দিন কোথায় ছিলেন রহিমা : রহিমা বেগমের আশ্রয় নেওয়া ফরিদপুরের বাড়ির মালিক কুদ্দুস বেশ কয়েক বছর আগে খুলনার সোনালী জুট মিলে চাকরি করতেন। তখন রহিমা বেগমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। পরে তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারীতের চলে যান। জিজ্ঞাসাবাদে ওই বাড়ির লোকজন পুলিশকে জানিয়েছেন, প্রথমে রহিমা বেগমকে তারা চিনতে পারেননি। পরে তাকে চিনতে পেয়ে সাবেক বাড়িওয়ালা হিসেবে তারা সেবাযত্ন করেছেন। রহিমা তাদের জানিয়েছিলেন, রহিমা বেশ কয়েক দিন চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ছিলেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর বোয়ালমারীর কুদ্দুসের বাড়িতে যান। তখন তার একটি ব্যাগে দুই প্যাকেট বিস্কুট, কিছু কাগজপত্র ও পরনের কিছু কাপড়চোপড় ছিল।
খুলনা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, রহিমার কাছে কোনো মোবাইল ফোন ছিল না। সে কারণে ট্র্যাকিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। রহিমা অপহরণ মামলাটির তদন্ত দৌলতপুর থানা-পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইতে গেছে। তারপরও খুলনা মহানগর পুলিশ মামলাটির ছায়া তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল।
রহিমা আসলেই অপহরণ হয়েছিলেন নাকি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন- এমন প্রশ্নের মোল্লা জাহাঙ্গীর বলেন, উনি কোনো জবাবই দিচ্ছেন না। খাবারদাবারও খেতে চাইছেন না। তবে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলছেন। মামলাটি যেহেতু পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্ত করছে, তারাই বিস্তারিত উদ্ঘাটন করবে। তবে তাকে যে বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাবাসাদে জানা যায়, তিনি চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর ও সর্বোশেষ ফরিদুপর ছিলেন।
আইনি ব্যবস্থা চান অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বজনেরা :
খুলনার দৌলতপুর থেকে রহিমা বেগম নিখোঁজের পরদিন মেয়ে আদুরী আক্তার থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। সেই মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, তাদের ঘায়েল করার জন্য ওই মামলা করা হয়েছিল। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে আত্মগোপন করেছিলেন রহিমা। বিষয়টি জানতেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নানসহ পরিবারের সদস্যরা।
খুঁজে পাওয়া রহিমা বেগম ও তার মেয়েদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মামলায় গ্রেপ্তার হেলাল শরীফের পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণও চেয়েছেন তারা। রবিবার সকালে হেলাল শরীফের স্ত্রী মনিরা আক্তার বলেন, ‘মরিয়ম মান্নানের সৎভাইয়ের কাছ থেকে ২০১৯ সালে জমি কিনেছিলাম। কিন্তু সেই জমির দখল তারা দেয়নি। এ জন্য সেখানকার স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে আমরা আবেদন করেছিলাম। তবে ওই পক্ষ এগোয়নি। বরং আমাদের নামে মানহানি মামলাও করেছিল। সেই মামলায় আমার স্বামীসহ পাঁচজন আসামি ছিলেন। সবাই আগাম জামিন নেন। পরে সেই পাঁচজনের নামে অপহরণ মামলা করা হয়েছে। আগের মামলায় জামিন হওয়ার পরই নতুন করে ফাঁসানোর জন্য তারা অপহরণের ঘটনা সাজায়।’
রহিমা নিজে আত্মগোপন করেছিলেন, এটা এখন পরিষ্কার বলে মনে করেন মনিরা আক্তার। তিনি বলেন, ‘শুধু ফাঁসানোই টার্গেট ছিল। মরিয়ম মান্নান সবকিছুই করল। অকারণেই আমাদের দিকে আঙুল তোলা হলো। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, গ্রেপ্তার কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। আমার স্বামী বের হলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমরা আশা করছি, দ্রুত আমার স্বামী ছাড়া পাবে।’
অপহরণ মামলায় স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সামাজিকভাবে অনেক হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়েছে মনিরা আক্তারকে। থানা-পুলিশ ও আদালতে ছোটাছুটি করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে বলে জানিয়েছেন মনিরা। তিনি বলেন, গত ৩০ আগস্ট তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর ৬ সেপ্টেম্বর তার কন্যাসন্তান হয়েছে। ১৩ অক্টোবর সন্তান প্রসবের নির্ধারিত দিন ছিল। কিন্তু স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আগেই সিজার করতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি স্বামীকে কাছে পাননি।