বগুড়া প্রতিনিধি
বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র
দেশে প্রথমবারের মতো ভেনিলা চাষে সফলতা
পরিবর্তনশীল জলবায়ু সহনীয় ও স্বল্পসময়ে অধিক উৎপাদনক্ষম উচ্চ গুণাগুণ সম্পন্ন জাত, উৎপাদন পদ্ধতি এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে কাজ করছে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রটি বহুমুখী উদ্ভাবনে তাক লাগিয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো মূল্যবান ফসল ভেনিলা চাষে সফল হয়েছে তারা। আবহাওয়া উপযোগী জাত চিহ্নিত করে চলছে গবেষণা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলে কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চায় কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। পাশাপাশি কালো এলাচ, গোলমরিচসহ অন্যান্য মসলার বাণিজ্যিক উৎপাদন নিয়েও গবেষণা করছেন এখানকার কর্মকর্তারা। গবেষণায় উদ্ভাবিত উন্নত নতুন জাত চাষাবাদে মসলার উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি হবে, এতে আমদানি নির্ভরশীলতা কমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা।
মসলা গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরই বিদেশ থেকে মসলা আমদানিতে গুণতে হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমদানিনির্ভরতা কমাতে বগুড়ার শিবগঞ্জে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মসলা গবেষণা কেন্দ্র পরের বছর থেকে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। ৫ বছর আগে ৮ হাজার কোটি টাকার মসলা আমদানি হলেও বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর নেপথ্যে রয়েছে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবন, উৎপাদন প্রক্রিয়া। এ পর্যন্ত ২৪টি মসলা জাতীয় ফসলের ওপর ৫০টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এর মধ্যে পেঁয়াজের ৭টিসহ মরিচ, রসুন, আদা, হলুদ, ধনিয়া, কালিজিরা, মেথি, ফিরিঙ্গী, মৌরি, আলুবোখারা, দারুচিনির উন্নত জাত কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদ হচ্ছে। কালো এলাচ, গোলমরিচের বাণিজ্যিক চাষাবাদসহ একাঙ্গী, চুইঝাল, ফিরিঙ্গি, পোলাও পাতা, লেমনগ্রাস, আম আদা, জিরা, কাবাবচিনি, চিভস, অলস্পাইস, কারিপাতা, পান বিলাস, লবঙ্গ, পেস্তা, জয়ফল বিভিন্ন মসলার জাত গবেষণাধীন এবং পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের গুঁড়া উদ্ভাবন হয়েছে এ কেন্দ্রে। সর্বশেষ মূল্যবান মসলা জাতীয় ফসল ভেনিলা চাষে সফল হয়েছে এ কেন্দ্রের গবেষকরা।
২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা ভেনিলা চারাগাছে ৩ বছর পর ফুল এসেছে, হাত দিয়ে পরাগায়নে ফলও ধরেছে। এতে প্রথমবারের মতো সফলতায় দেশের আবহাওয়া উপযোগী জাত চিহ্নিত করে গবেষণা চলছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলে কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞদের। বেকারিসামগ্রী, প্রসাধনী ও ওষুধ তৈরিতে ভেনিলা ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশের ব্যবহৃত ভেনিলা আমদানিনির্ভর। লতা জাতীয় অর্কিড ভেনিলা, ছায়াযুক্ত স্থানে অন্য কোনো উদ্ভিদ বা খুঁটি বেয়ে ওপরের দিকে উঠে। প্রাকৃতিকভাবে সাধারণত আর্দ্র, গ্রীষ্মম-লীয় নি¤œাঞ্চলের বনভূমি পছন্দ করে ভেনিলা।
পতিত জমি, বাগানে, পাহাড়, ঘন বনে স্বল্প খরচে চাষাবাদ করা যাবে। দেশে প্রতি বছর ৫৮ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে মসলার উৎপাদন প্রায় ৪৫ লাখ টন। মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবিত উন্নতজাত কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণে আমদানিনির্ভরতা শূন্যের কোঠায় আসবে বলে প্রত্যাশা গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞদের।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু হেনা ফয়সাল ফাহিম জানান, দেশে প্রথমবারের মতো আমরা ভেনিলা চাষে সফল হয়েছি। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় খুব সহজেই খাপ খেয়ে নেবে। পতিত জমিসহ ফলবাগান ও পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে অন্য ফসল সম্ভব নয় সেখানে ভেনিলা সহজেই চাষাবাদ হবে। অন্য কোনো আবাদি জমি নষ্ট না করেই একেবারেই স্বল্প খরচে ভেনিলা চাষ করা যাবে। দেশের আবহাওয়া উপযোগী জাত পেয়েছেন তারা, এটা নিয়ে গবেষণা চলছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য আবেদন করা হবে। অনুমতি পেলে কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানান ভেনিলা নিয়ে গবেষণা করা এই বিশেষজ্ঞ।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রে কালো এলাচ চাষে গবেষণা চলছে বলে জানান বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাহমুদুল হাসান সুজা। তিনি বলেন, আবহাওয়াগত কারণে ফুল থেকে ফল হচ্ছে না। তাই হাত দিয়ে পরাগায়নের চেষ্টা করছি। এ বছর আমরা সফল না হলেও আগামী বছর এ নিয়ে আরো গবেষণা করা হবে, সেক্ষেত্রে সফলতা এলে পাহাড়ি এলাকায় যেখানে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সেখানে চাষাবাদ শুরু হবে।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, মসলা জোরদারকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতগুলো ও প্রযুক্তি কৃষকদের বিভিন্নভাবে অবহিত করা হচ্ছে। অনেক কৃষক এই জাত চিনত না, প্রকল্পের ফলে বীজ উৎপাদন বেড়েছে। এতে কৃষক প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস বিভিন্ন কর্মশালায় আমাদের প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে ছড়াতে সক্ষম হয়েছি। এতে করে কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বাড়ছে। যেহেতু অন্যান্য মাঠ ফসলের তুলনায় মসলা চাষ লাভজনক তাই কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে। পাশাপাশি প্রতিকূল আবহাওয়া বা প্রতিকূল পরিবেশ বিশেষ করে চরাঞ্চল, লবণাক্ত এলাকাসহ পাহাড়ি এলাকায় মসলা উপাদনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হরিদাস চন্দ্র মোহন্ত বলেন, মসলার মধ্যে ২য় মূল্যবান ফসল ভেনিলা; যা নিয়ে গবেষণা চলছে। ভেনিলা কেকসহ বেকারি সামগ্রীতে ব্যবহার হয়।
তিনি আর বলেন, আমাদের দেশে জিরা হতো না, গত বছর আমাদের বিজ্ঞানীরা জিরার জাত উদ্ভাবন হয়েছে। মসলার নতুন নতুন জাত আসছে যা দিয়ে মসলার ঘাটতি অনেকখানি পূরণ হবে। ভবিষ্যতে মসলার আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।