মাসুদ রানা, বরিশাল
বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর, ইতিহাস যেখানে কথা কয়
দর্শনার্থী পাচ্ছে না বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর। সাত বছর আগে জাদুঘরের দ্বার উন্মুক্ত করা হলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে জাদুঘরটিতে দর্শনার্থী তেমন আসছে না। এই দর্শনার্থী না আসার প্রধান কারণ প্রচারের অভাব। এছাড়া জাদুঘরটির আয়তন ও অঙ্গনের ছোট আয়তন। কিন্তু এই জাদুঘরটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। সেখানে গেলে দেখা মেলে অতিতের, ইতিহাস বলে কথা।
জাদুঘরের সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. হাসানুজ্জামান জানান, গড়ে দৈনিক ২০-২৫ জন দর্শনার্থী একটি জাদুঘরের জন্য পর্যাপ্ত না। জাদুঘরের জন্য যে এরিয়া প্রয়োজন, সেই এরিয়া আমাদের নেই। শুধু জাদুঘর থাকলেই হবে না। সঙ্গে বিস্তৃত এলাকা, গাছ-গাছালি, পুকুর নিরিবিলি বসার স্থান থাকলে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ত। খোলামেলা পরিবেশ পেলে দর্শনার্থীরা এসে ঘোরাফেরা করত। ফাঁকে জাদুঘরে প্রবেশ করত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগে কার্যালয় নেই। খুলনার বিভাগীয় প্রত্নত্বত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন এই জাদুঘর। ফলে এর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ হয় না। যার কারণে জাদুঘরটি উপেক্ষিত রয়েছে। জাদুঘরের প্রবেশপথে রয়েছে একটি পান-সিগারেট বিক্রির দোকান। দোকানি দেলোয়ার হোসেনের মন্তব্য জাদুঘরে লোকজন আসে না। তাই তার দোকানে বেচাকেনা নেই। দেলোয়ার বলেন, এখানে যে জাদুঘর আছে, তা অনেকেই জানে না। এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণাও নেই। গেটে একটি টেবিলে টিকিট নিয়ে বসে থাকা জাদুঘরের পরিচারক পরিচয় দেওয়া মো. আবদুল ওহাব বলেন, জাদুঘরে প্রবেশ করতে হলে ১০ টাকা ও ৫ টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। তিনি বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ টাকা করে নেওয়া হয়। অন্যদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ১০ টাকা। তিনি জানান, রবিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে। সোমবার ২টার পর খোলা হয়। তিনি বলেন, আগে তেমন দর্শনার্থী আসত না। এখন আসতে শুরু করেছে।
দর্শনার্থী উজিরপুর উপজেলার পল্লী চিকিৎসক দীলিপ বলেন, একটু কাজে এসেছি বরিশাল। জাদুঘর দেখে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। তিনি বলেন, বরিশালে জাদুঘর আছে, সেটা জানতাম। কিন্তু কোথায়, সেটা জানতাম না। দিলীপ বলেন, জাদুঘরে দর্শনার্থী বাড়ানোর জন্য আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশিষ্টজনদের এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হবে। তাহলে জাদুঘরে আসতে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। জাদুঘরের পরিবেশ তার কাছে তেমন ভালো লাগেনি মন্তব্য করে বলেন, সবকিছুতে একটা জাঁকজমক থাকতে হয়। এখানে তা নেই। ব্যাপক আলোকসজ্জা ও ভবনের রং করে দৃষ্টিকাড়া রূপ দিতে হবে। জাদুঘর ঘুরে দেখা গেছে, প্রাচীন অনেক পুরাকীর্তিতে ভরপুর রয়েছে ৯টি গ্যালারি। ১২-১৩ শতকের শিবলিঙ্গ, ১৪-১৫ শতকের শিবলিঙ্গ ও গৌরিপত্র, একাদশ-দ্বাদশ শতকের তৈরি পেঁচার ওপর বসে থাকা লক্ষ্মী মূর্তি। এছাড়াও ১১-১২ শতকের একটিসহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন বিষ্ণু মূর্তি রয়েছে এ জাদুঘরে। রয়েছে প্রাচীন দেব-দেবীর মূর্তি অলংকৃত ইট, বিভিন্ন যুগের প্রাচীন মুদ্রা, পাথরের তৈরি তৈজসপত্রসহ ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী শতাধিক পুরাকীর্তির নিদর্শন।
সহকারী কাস্টোডিয়ান হাসানুজ্জামান বলেন, প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কবে ওই চিঠি দিয়েছেন তা বলতে পারেননি তিনি। হাসানুজ্জামান বলেন, আগে জাদুঘরে প্রবেশের একটি পথ ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধান সড়কের পাশে আরেকটি প্রবেশপথ করার পর দর্শনার্থী বেড়েছে। তিনি জানান, গত আট মাসে জাদুঘরে ৫ হাজার ৯৪৭ জন দর্শনার্থী এসেছিল। হাসানুজ্জামান বলেন, বৃহত্তর বরিশালের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার লক্ষ্যে নগরীর ফজলুল হক অ্যাভিনিউ এলাকায় পুরোনো কালেক্টরেট ভবনে গড়ে তোলা হয় বিভাগীয় জাদুঘর। খোদ ভবনটিই একটি পুরাকীর্তি। ১৮২১ সালে এটি নির্মিত হয়েছিল, ১৯৮৪ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
২০০৪ সালে ভবনটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। প্রয়োজনীয় সংষ্কার ও সংরক্ষণ শেষে এই ভবনেই স্থাপন করা হয় জাদুঘর। ২০১৫ সালের ৮ জুন এটির উদ্বোধন হয়। পুরোনো কালেক্টরেট ভবন ব্রিটিশ শাসনামলের স্থাপত্য ঐতিহ্যের স্মারক। এটি তৎকালীন পূর্ববঙ্গে নির্মিত প্রথম প্রশাসনিক ভবন। জাদুঘরে ভবনটির ইতিহাস, স্থাপত্যশৈলীর বিবরণ, আলোকচিত্র ও নির্মাণ উপকরণসহ বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে। দোতালায় সজ্জিত ৯টি গ্যালারিতে ফারসি হরফে উৎকীর্ণ মুসলিম যুগের শিলালিপি, গুপ্ত যুগের পোড়ামাটির নিদর্শন, প্রস্তর নির্মিত পাল যুগের বুদ্ধমূর্তি, পদ্মখচিত সুলতানি যুগের পোড়ামাটির ফলকচিত্র, মাটির সামগ্রী, তৈজসপত্র, গ্রামোফোন রেকর্ডার (কলের গান), আসবাব, শিবলিঙ্গ, মারীচী মূর্তি, কৃষ্ণমূর্তি, হরগৌরি মূর্তি, মহাদেব মূর্তি, ব্রোঞ্জের বদনা, পাথরের মালাসহ অনেক মূল্যবান, দুষ্প্রাপ্য ও আকর্ষণীয় নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে বরিশাল বিভাগের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিচিতি। বরিশাল বিভাগের কীর্তিমানদের তথ্য ও আলোকচিত্র। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও শিল্পকলায় উপস্থাপন করা হয়েছে বরিশালের গৌরবময় সমৃদ্ধ ইতিহাস।