জহিরুল ইসলাম, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)

  ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ঋণের ফাঁদে জেলে জীবন

ফাইল ছবি

পটুয়াখালী উপকূলে ঋণগ্রস্ত জেলেদের সংখ্যা বাড়ছে। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ঘরবাড়ি ছাড়ছেন অনেকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেরা সংসারের ভরণপোষণ চালাতে এই ঋণ করে থাকেন। কারণ সরকার যা দেয় তা দিয়ে জেলেদের সংসার খরচ হয় না। ফলে তারা ঋণের ফাঁদে পড়ছেন। ঋণের দুষ্টচক্র থেকে তারা রেহাই পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, প্রচলিত ব্যাংকের সুদের হার কম হলেও সেখান থেকে জেলেদের ঋণ পাওয়া সহজ নয়। ফলে তারা উচ্চ সুদ হারে অপ্রচলিত সুদখোর মহাজন এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ওই ঋণের সুদ আর কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে এখন তারা দিশাহারা।

ঋণের ফাঁদে পড়ে বাড়ি ছাড়া : কুয়াকাটা নবীনপুর গ্রামের বাসিন্দা সেলিম মাঝি। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েসহ সপরিবারে ঘরবাড়ি ফেলে পাড়ি জমান চট্টগ্রামে। স্থানীয়রা জানান, অর্থাভাবে সংসার চালাতে সেলিম মাঝি বিভিন্ন সময়ে চড়া সুদে প্রায় ১৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিস্তি ও সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চাপের মুখে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

কুয়াকাটা ৩নং ওয়ার্ডের মনোয়ার মাঝি। স্থানীয় সুদি মহাজন থেকে ঋণ নেন প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দেওয়ার শর্তে। ওই টাকা শোধ করতে আরেকটি এনজিও থেকে ঋণ নেন। এভাবে তিনি ঋণের চক্রে পড়ে সপরিবারে বাড়ি ছাড়া হয়েছে।

স্থানীয় আরেক জেলে লিটন আকন বলেন, ৪ বছর আগে ২ লাখ টাকা ঋণ করে ব্যবসা শুরু করেন। উচ্চ সুদের ঋণের ফাঁদে পড়ে বর্তমানে ১৩ লাখ টাকা ঋণের বোঝা বহন করছেন।

তিনি আরো বলেন, কিস্তির টাকা সময়মতো না দিতে পারলে সুদি মহাজনরা ট্রলার আটকে দেয়।

কুয়াকাটা জেলে সমিতির সভাপতি নিজাম শেখ জানান, ৪ বছরে কুয়াকাটার প্রায় ৪০০ জেলে এই পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। বর্তমানে ২৪০০ জেলে পরিবারসহ ঋণের ফাঁদে পড়ে অভাবে অসহায় অবস্থায় আছি। আমরা কেউই জেলে পেশায় থাকতে চাই না। আমাদের বিকল্প পেশার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।

জেলেরা টিকে থাকবে কীভাবে : পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাসান উদ্দিন বলেন, জেলেদের ঋণগ্রস্ততা নিয়ে আমরা উদ্বেগজনক খবর পাচ্ছি। বাংলাদেশের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ এই খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত জেলেরা সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সুদের হার কম হলেও তারা প্রান্তিক জেলেদের ঋণ দেয় না। কিছু কিছু এনজিও ঋণ দিয়ে থাকে উচ্চ মাত্রার সুদ হারে। ফলে জেলেরা এই ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। এ ছাড়া দেখা যায় সরকার মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকেন। তখন জেলেদের ভরণপোষণের জন্য সরকার যা দেয় তা দিয়ে সংসার খরচ হয় না।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, মৌসুমে অনেক পরিমাণে মাছ ধরে কিন্তু তারা ন্যায্য দাম পায় না। এই কারণে দেখা যায় ঋণ নেওয়ার পর তারা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারেন না। এই যে ঋণের একটি চক্র সৃষ্টি হয়, এখান থেকে বের হওযার একটি দীর্ঘমেয়াদি আরেকটি স্বল্প মেয়াদি উপায় রয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত জেলে পরিবার থেকেই নতুন মৎসজীবী তৈরি হয়। সরকার যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জেলেদের মাছ ধরার আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে জেলে সন্তানদের শিখিয়ে সক্ষমতা করে তুলতে পারে তাহলে সাগরে মাছ ধরে তারা অবদান রাখতে পারবে। অন্যদিকে দেখা যাবে আমাদের প্রশিক্ষিত জেলেরা নরওয়ে, অস্ট্র্রেলিয়াতে অভিবাসী হিসেবে ভিসা পাবে। এতে দেশের রেমিট্যান্স আয় বাড়বে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫০টির মতো লিস্টেড বীমা কোম্পানি আছে। সরকারের উচিত এসব কোম্পানিগুলো বাধ্য করা উপকূলীয় জেলেদের বীমার আওতায় আনার জন্য। তাতে করে যা হবে, একটা জেলে যখন সাগরে অকাল মৃত্যু হয় তখন তার পরিবারের বীমার সুবিধা দিয়ে ভরণপোষণ চালানো সম্ভব হবে এবং ডিপোজিটকৃত অর্থ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারবেন।

স্বল্প মেয়াদি উপায়, জেলেপাড়ায় জেলেদের নিয়ে কমিউনিটি বেইজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি করতে হবে। যখন জেলেরা এই সমবায়ের মাধ্যমে ব্যাংকে ঋণ নিতে যাবেন ব্যাংক তখন ঋণ দিতে ভরসা পাবে। অর্থাৎ সমিতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলো জেলেদের মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ ঋণ আকারে দেবে। অন্যদিকে জেলেরা সমিতির মাধ্যমেই মাছ বিক্রি করতে বাধ্য থাকবেন। এতে করে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন।

সরকার যখন মাছের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যেমন- মাছ ধরার উপকরণ তৈরির কারখানা স্থাপন করে দিলে জেলেরা অবসর সময়ে সেখানে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। সেই আয়ের কিছু অংশ দিয়ে তারা তাদের ধারদেনা পরিশোধ করতে পারবে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কলাপাড়া,জেলে
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close