আব্দুস শুকুর, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)

  ১৭ আগস্ট, ২০২২

শত কোটি টাকা ক্ষতির মুখে চা শিল্প

শ্রমিক আন্দোলনে কোটি কেজি কাচা চা পাতা নষ্ট

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

মজুরি বৃদ্ধির দাবি নিয়ে সারাদেশে কর্মবিরতি পালন করছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। তাদের দাবি ১২০ টাকা মজুরিতে দ্রব্য মূল্যের এই বাজারে তারা অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন। মজুরি বৃদ্ধি না হলে তারা আন্দোলন করে যাবেন। শ্রমিকদের টানা এই কর্মবিরতীর কারণে বিভিন্ন বাগানে লাখ লাখ কেজি কাচা চা পাতা নষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাগান মালিকরা। তারা ইতিমধ্যে নিজ নিজ বাগানের পক্ষ থেকে এ নিয়ে থানায় জিডিও করেছেন।

বাগান মালিক কর্তৃপক্ষের দাবী সকল চা বাগান হিসেব করলে এক কোটি কেজির উপরে চা পাতা নষ্ট হচ্ছে। কারণ, অনেক বাগানে কাঁচাপাতা প্রসেসিংয়ের জন্য উত্তোলন করা হয়েছিল। আবার অনেক চা পাতা প্রসেসিং এর বিভিন্ন ধাপে ছিল। বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ না দেওয়ায় সেই পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাগান জুড়ে চায়ের ভরা মৌসুম।

জেমস ফিনলের মালিকানাধীন ডিনষ্টন (খেজুরী ছড়া) চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক খালিদ হাসান রুমী বুধবার (১৬ আগস্ট) রাতে শ্রীমঙ্গল থানায় একটি জিডি করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে নিরানব্বই হাজার দুইশত কেজি কাঁচা পাতা প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয়নি। এই কাঁচা চা পাতা থেকে ২২ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হতো, যার বাজার মূল্য আনুমানিক পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। এদিকে এক লাখ ৪৮ হাজার ৭৩৫ কেজি চা পাতা নষ্ট হওয়ার অভিযোগ করেছেন ফিনলে চা কোম্পানির রাজঘাট ডিভিশন থেকে। এ বিষয়ে রাজঘাট চা বাগানের সহকারি ব্যবস্থাপক মাহমুদ হাসান শ্রীমঙ্গল থানায় একটি জিডি করেছেন। রাজঘাট চা বাগান সূত্রে জানা গেছে, চা শ্রমিকের এই কর্মবিরতির কারণে এ পর্যন্ত তাদের বাগানে প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। জঙ্গলবাড়ি চা বাগানের ব্যবস্থাপক এস এন এম মাহবুব আলম মিসবাহ্ দাবি করেছেন তার বাগানের ৩৫ হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা নষ্ট হয়েছে। শ্রমিক কাজে না আসার কারণে পাতাগুলো প্রসেসিং করা সম্ভব হয়নি। চা শ্রমিকের এই কয়দিনের কর্ম বিরতিতে তার বাগানের প্রায় ৫০ লক্ষাধিক টাকা ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে টি অ্যাসোসিয়েশন তথ্য মতে জানা যায়, চা শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে সিলেট ও চট্টগ্রামের ১৬৮ চা বাগানে থেকে দৈনিক ২০ কোটি টাকার অধিক মূল্যমানের চা পাতা নষ্ট হচ্ছে।

সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা বলছে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের একটা সমাধান দরকার। চা শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে। এমতাবস্থায় শ্রমিকদের আন্দোলন চলতে থাকলে শিল্পটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তারা বলেন এ কয়দিনের আন্দোলনে শত কোটি টাকার উপরে চা শিল্পের ক্ষতি হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশুভ সংকেত।

শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা গত দুই দিনে ৪টি বাগানের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়রির আবেদন পেয়েছি। প্রতিটি কারখানা সরেজমিনে ভিজিট করে তার সত্যতা নিশ্চিত করা হবে।

বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, ‘মজুরি বাড়ানো নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা চলছিল। আলোচনা চলাকালে এভাবে কাজ বন্ধ করে আন্দোলন করা শ্রম আইনে বেআইনি।

তিনি বলেন, এখন চা বাগানে ভরা মৌসুম। কাজ বন্ধ রাখলে সবার ক্ষতি। শ্রমিকরাও এই মৌসুমে কাজ করে বাড়তি টাকা পায়। শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতার প্রসঙ্গে গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, ‘আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি যাতে শ্রমিকদের কাজে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়।

উল্লেখ্য, এক সপ্তাহ ধরে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন শ্রমিকরা। গত শনিবার থেকে দেশের ১৬৬টি বাগানে শুরু করেছেন অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। ধর্মঘট চালাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। শোক দিবসের কারণে দুদিন আন্দোলন কর্মসূচি শিথিল ছিল। মঙ্গলবার থেকে ফের কর্মবিরতি শুরু করেছেন দেশের ১৬৬টি চা বাগানের চা শ্রমিকরা।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, আমরা মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু এতে কোনো সাড়া না পেয়ে ৮ আগস্ট থেকে আন্দোলন শুরু করি। এরপর বৃহস্পতিবার মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে সমঝোতা বৈঠক আহ্বান করে বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তর। এতে শ্রমিক নেতারা গেলেও মালিকপক্ষের কেউ আসেননি। ফলে শনিবার থেকে আমরা দেশের সবগুলো চা বাগানের ধর্মঘট শুরু করেছি।

চা শিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরী বলেন, সব সুবিধা মিলিয়ে একজন শ্রমিকের পেছনে আমাদের দৈনিক ৪৫০ টাকা খরচ করতে হয়। বাগানে দিন দিন শ্রমিক বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে উৎপাদন বাড়ছে না।

বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক শ্রমিক নেতা জানান, বৈঠকে শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মালিকদের হয়ে কথা বলেন। তারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের জন্য শ্রমিকদের চাপ দেন। এভাবে ধর্মঘট আহ্বান আইন পরিপন্থী বলেও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন।

এ ব্যাপারে শ্রম দপ্তরের শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের উপপরিচালক নাহিদুল ইসলাম বলেন, কাজ বন্ধ করে শ্রমিকেরা আন্দোলনে গেলে মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষেরই ক্ষতি হবে। আমরা বিষয়টি সমাধানের জন্য শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা বৈঠক করেছি।

আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ২৩ আগস্ট তাদের সঙ্গে বসতে সময় চেয়েছেন। আপাতত আন্দোলন স্থগিত রাখতে বলেছেন। কিন্তু চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতরা সেটা মানেননি।এভাবে ভরা মৌসুমে হুট করে ধর্মঘট ডাকা আইন পরিপন্থি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা হুট করে ধর্মঘট ডেকে বসলে সেটা আইন পরিপন্থি বলা হয় না। অথচ আমরা ন্যায্য দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে ব্যর্থ হয়ে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে ধর্মঘটে গেলাম। এটাকে বলা হচ্ছে আইন পরিপন্থি। আমাদের দাবী মেনে না নিলে আন্দোলন চলবে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোটি টাকা,চা শিল্প,নষ্ট,শ্রমিক আন্দোলন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close