মো. হেলাল উদ্দিন উজ্জ্বল, ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ)

  ০৮ আগস্ট, ২০২২

শিকলে বন্দি লাভলীর দিন

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

লাভলী আক্তারকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে মানসিক ভারসাম্যহীন। অন্য দশ জনের মত স্বাভাবিকভাবে কথার উত্তর দেয়। দুই বছর যাবত নিজ ঘরে শিকলে বেধে রাখা হয়েছে তাকে। ডাক্তাররা বলছেন, চিকিৎসা করাতে পারলে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু অভাবের কারণে চিকিৎসা করাতে পারছেনা লাভলীর হতদরিদ্র পরিবার।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শাহেদ্দা বাড়ি গ্রামের আ. মালেকের মেয়ে লাভলী আক্তার। প্রায় ৮ বছর আগে নিজ গ্রামেই বিয়ে হয়। সেখানে এক পুত্র সন্তান হয়। সন্তান হওয়ার কয়েক মাস পর তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। স্বামী তালাক দিয়ে চলে যায়। চিকিৎসা করে সুস্থ্য করে তোলেন হতদরিদ্র পিতা-মাতা। প্রায় চার বছর আগে পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড গৌরিপুর এলাকার ভ্যান চালক রুবেল মিয়ার কাছে লাভলীকে বিয়ে দেওয়া হয়। তাদের ঘরে দুই সন্তান হয়। বড় মেয়ে আফরুজার বয়স যখন প্রায় দুই বছর ও ছেলে লাবিবের বয়স ৮ মাস তখন আবারও মানসিক সমস্যা দেখা দেয় লাভলীর। দুই সন্তানসহ তাকে তার পিতার বাড়ি পাঠিয়ে দেয় স্বামী রুবেল মিয়া। এরপর আর কোন খোঁজখবর নেয় না।

লাভলীর পিতা আ. মালেক এক সময় দিনমজুরির কাজ করতেন। এখন মানসিক অসুস্থ্য, কিছুই করতে পারেন না। মা নুরজাহান ঢাকায় বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। একাই বাড়িতে শিকলে বাধা থাকে লাভলী। বাড়ি ভিটা ছাড়া তাদের জমি নেই। নিজেদের সংসার চলে না, তারমধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ে ও তার দুই সন্তান। অভাবের কারণে লাভলীর দুই সন্তানকে দত্তক দেওয়া হয়েছে। এরপর দিন দিন লাভলীর পাগলামি বাড়তে থাকে। বাড়ি ঘর ভাংচুর করে। গ্রামের মানুষদের মারপিট করে। দিনরাতে বাড়ি ছেড়ে অনত্র চলে যায়। যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে। মানুষজনও তাকে মারপিট করে। গত দুই বছর যাবত শিকলে বেধে রাখলেও মাঝে মধ্যে শিকল খুলে দিত বাড়ির লোকজন। শিকল খুলে দিলে বাড়ি ঘরে ব্যাপক ভাংচুর করে, দা দিয়ে সব কুপিয়ে কেটে ফেলে। বাড়িতে মলমূত্র ছিটায়। তার পিতা-মাতা থাকে ঢাকায়। গত চার মাস যাবত ঘরে শিকলে বেধে রাখা হয়েছে লাভলীকে। বাঁধা অবস্থায় বাড়ির লোকজন খাবার দেয়, মাঝে মধ্যে গোসল করায়। ঘরেই মলমূত্র ত্যাগ করে। তার মা ঢাকা থেকে বাড়ি এসে যে কয়দিন থাকেন, সে কয়দিন বাধা অবস্থায় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে লাভলী।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টিনসেড একটি খুপড়ি ঘরের মাঝখানের খুটিতে ডান পায়ে শিকলে বাঁধা লাভলী আক্তার। মাটিতে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তেমন কথাবর্তা বলেনা। চোঁখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। মাঝে মধ্যে হাসছে, আবার কাঁদছে। শিকলে বাঁধার কারণে ডান পায়ে কালচে দাগ হয়েগেছে। শিকলে বাঁধা অবস্থায় ঘরের মাঝেই মলমূত্র ত্যাগ করে। দূর থেকে খাবার দেওয়া হয়। যে কোন কথা জানতে চাইলে একটু পর পর স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয়। তাকে স্বামী রেখে চলে গেছে, দুই সন্তান পুইন্না (দত্তক) দিয়েছে। সে পাগল না, জোর করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার পায়ের বাঁধন খুলে দিতেও বলে। লাভলীর পাশে একটি চৌকিতে তার পিতা মালেক। সেও কিছুটা মানসিক রোগী। মা নুরজাহান বেগম বাড়ির উঠানে বসে কান্না করছেন, মেয়েকে শিকলে বেঁধে আবার ঢাকায় চলে যাবেন ঝিয়ের কাজ করতে। কাজ করতে না পারলে মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারবেন না, সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।

ফারুক হোসেন, খাইরুল ইসলামসহ একাধিক প্রতিবেশি বলেন, লাভলী ভালো ছিল, হঠাৎ করে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসায় ভালো হয়েছিল। আবারও মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। অভাবের কারণে সংসার চলে না, দুটি সন্তান দত্তক দিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসা করাবে কির করে ? তার মা লাভলীকে বেঁধে রেখে ঢাকায় চলে যান, বাসা বাড়িতে কাজ করতে।

মা নুরজাহান বেগম বলেন, মেয়েডা ভালা আছিন, বিয়া অইছিল বাচ্চাও ছিল। হঠাৎ কইরা পাগলা অইয়া গেছে, ডাক্তর দেহাইয়া ভালা করছিলাম। অভাবের লিগা অহন চিগিৎসা (চিকিৎসা) করবার পাইনা। ডাক্তর কইছে ঠিকমত চিগিৎসা করাবার পাইলে এক্কেবারে ভালা অইয়া যাব। মেয়েডার একটা ভাতা কার্ড হয়নি, ভাতা পাইলে চিগিৎসা করবার পাইতাম। নিজের মাইয়ারে শিকলে বাইন্দা কাম করবার লিগা ঢাহা যামুগা, কেডা আমার পাগলা মাইয়াডারে দেখব।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, মেয়েটির চিকিৎসার জন্য এককালীন কিছু টাকা ও একটি ভাতা কার্ডের ব্যবস্থা করা যাবে। তার পরিবার চাইলে সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পে রাখার সুপারিশ করতে পারব।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. হারুন আল মাকসুদ বলেন, হয়তবা মেয়েটি কোন সময় ব্যাপক মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যেহেতু এখন স্বাভাবিক কথাবর্তা বলে, ঠিকমত চিকিৎসা করালে ভালো হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
লাভলী,মানসিক ভারসাম্যহীন,শিকল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close