রাজশাহী ব্যুরো

  ২১ জুলাই, ২০২২

রেলের টিকিট না পেয়ে স্টেশনে তুলকালাম কাণ্ড, ভিডিও ভাইরাল 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কালোবাজারির কারণে দীর্ঘদিন থেকেই সাধারণ যাত্রীদের জন্য টিকিট পাওয়া যেন সোনার হরিণ। আর হঠাৎ একদিন ‘কালোবাজারি’র টিকিট না পেয়ে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘অশ্লীল’ ভাষায় গালাগাল করেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এক কর্মচারী। এসময় রেলওয়ের সাবেক এক কর্মকর্তাকেও চরম উত্তেজিত হয়ে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়। গত রবিবার (১৭ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিকিট না পেয়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে অশ্লীল গালাগালের সেই ভিডিও এর মধ্যে ভাইরাল হয়েছে।

অশ্লীল ভাষায় গালাগালকারী রেলওয়ের ওই কর্মচারীর নাম বেদব্রত সিনহা। তিনি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আর তার সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারসহ কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে হুমকি প্রদানকারীর নাম ওয়ালী খান। তিনি রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর।

এদিকে ট্রেনের টিকিট না পেয়ে দায়িত্বরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে রেলের সাবেক ও বর্তমান এই দুই কর্মচারীর হুমকি-ধমকি ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করার ঘটনায় রেলওয়ে জিআরপি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিন ওই দুইজনের বিরুদ্ধে এই জিডি করেন।

অভিযোগ উঠেছে, ‘নেশাগ্রস্ত’ অবস্থায় গত রবিবার রাতে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে যায় রেলের কর্মচারী দেবব্রত সিনহা। তার সঙ্গে মহানগর শ্রমিক লীগ নেতা ও সাবেক রেল কর্মকর্তা ওয়ালী খানও যান। তারা গিয়েই কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে হইচই শুরু করেন। চাহিদামত টিকিট না পাওয়ায় তখন চরম উত্তেজিত হয়ে দেবব্রত সিনহা রেলের দুই কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে ‘অশ্লীল’ ভাষায় গালাগাল করেন। এসময় ওয়ালী খান টিকিট না পেয়ে জিএমকে উদ্দেশ্য করে হুমকি-ধামকি দেন এবং স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিনকে তৎক্ষণাৎ স্টেশন মাস্টারের কক্ষে ডেকে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেন।

রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিন বলেন, ‘দেবব্রত সিনহা রেলের একজন কর্মচারী। কিন্তু তার অত্যাচারে বুকিং সহকারীরা অতিষ্ঠ। সাধারণত বুকিং সহকারীদের ডিউটি না থাকলে টিকিট কাউন্টারের অভ্যন্তরে প্রবেশ নিষেধ। অথচ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী দেবব্রত প্রতিনিয়ত টিকিটের জন্য কাউন্টারের অভ্যন্তরে জোরপূর্বক প্রবেশ করেন। টিকিট না দেয়া পর্যন্ত কাউন্টারের কম্পিউটার ও সার্ভারের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। প্রতিদিনের মত তিনি ১৬ জুলাই এসে ১৭ তারিখের যাত্রার টিকিটের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু ১৭ তারিখে জিএম স্যারসহ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় যান। যার কারণে তাকে আমি টিকিট দিতে পারিনি। এজন্য ১৭ জুলাই রাতে দেবব্রত তার কয়েকজন বাহিনী নিয়ে আমাকে খোঁজার জন্য জোরপূর্বক কাউন্টারে প্রবেশ করে কাউন্টার অফিস ঘেরাও করেন।

তিনি বলেন, ওই দিন দুই দিনের টিকিট বিক্রির প্রায় ৬০-৭০ লাখ টাকা কাউন্টার অফিসে ছিলো। যেখানে অন্য কারও কাউন্টারের অভ্যন্তরে প্রবেশ নিষেধ থাকলেও সেখানে তিনি টিকিটের জন্য প্রতিনিয়ত জোরপূর্বক সেখানে ঢুকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। আর ১৭ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে আমাকে কাউন্টারের অভ্যন্তরে না পেয়ে কতর্ব্যরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে আমিসহ রেলের আরও দুই একজন কমকর্তাকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য-অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন। তাই জীবনের নিরাপত্তা ও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রেলওয়ে জিআরপি থানায় জিডি করেছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও সিসি টিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, গত ১৫ জুলাই টিকিটের জন্য দেবব্রত সিনহা ৩ বার (সকালে একবার ও বিকালে দুইবার) কাউন্টার অফিসের ভেতরে প্রবেশ করেন। প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিন জানান, ওইদিন সে ১৬ তারিখের যাত্রার ধূমকেত এক্সপ্রেস ট্রেনের ৭টি এসি চেয়ার, পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের ৪টি এসি চেয়ার, সিল্কসিটির ১টি এসি চেয়ার এবং এই তিন ট্রেন মিলিয়ে ১২টি শোভন চেয়ারের টিকিটসহ মোট ২৪টি টিকিট আমাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যান। এর আগের দিন ১৪ জুলাই একইভাবে ২০-২৫টি টিকিট নিয়ে যান। এভাবে দীর্ঘদিন থেকে তিনি একই কাজ করে আসছে। কিন্তু ১৬ তারিখে আবার তিনি ১৭ তারিখের যাত্রার টিকিটের জন্য আসলে দেয়া সম্ভব না হওয়ায় ১৭ তারিখ রাতে দায়িত্বরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে।’

রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর ওয়ালী খান বলেন, ‘যা সত্য তাই বলছি। সবাই টিকিট পায় আর আমরা টিকিট পাই না। তাই কেন আমরা টিকিট পাই না তা জানার জন্যই মূলত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়েছিলাম।’

অভিযুক্ত পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী ও রেলওয়ে শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদক দেবব্রত সিনহা বলেন, ‘আমি ১৪ তারিখে তিনটি টিকিট নিয়েছি মাত্র। আর কখনো টিকিট নেইনি। জমসেদ নামের একজন রেলওয়েতে চাকরি করেন না। অথচ তাকে টিকিট দেয়া হলেও আমাকে দেয়া হয়নি। এজন্য আমি জমসেদকে গালাগালি করেছি। ১৫ জুলাই আপনি ৩ বার স্টেশন কাউন্টারের অভ্যন্তরে কেন গিয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টিকিট নিতেই গিয়েছিলাম, কিন্তু টিকিট দেয়া হয়নি। মূলত রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় করার জন্য রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান উঠেপড়ে লেগেছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে রেলের এই কর্মচারি বলেন, ‘ওই দিন স্টেশন মাস্টারের কক্ষে যা বলেছি ইচ্ছে করে নয়। তবে এগুলো বলা আমার উচিত হয়নি।’

পশ্চিমাঞ্চল রেলের জিএম অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘কালোবাজারির টিকিট দেয়া বন্ধ করার কারণেই স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে ওই কর্মচারী উত্তেজিত হয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিয়েছেন। আমি ঢাকায় আছি, লিখিত অভিযোগ পেলে ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

উল্লেখ্য, গত সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কালোবাজারির টিকিট বিক্রির সময় স্টেশনের প্লাটফর্মে জিয়াউর রহমান (৩৬) নামে রেলওয়ের এক কর্মচারীকে আটক করেছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। এসময় ধূমকেতু এক্সপ্রেসের ৫টি কালোবাজারির টিকিটও জব্দ করা হয়। আটককৃত কর্মচারী রাজশাহী মহানগরীর রেল কলোনি এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে এবং পশ্চিম রেলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে বার্তাবাহক হিসেবে কর্মরত। পরে অবশ্য মুচলেকায় ছাড়া পান তিনি। টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জিএম অসীম কুমার তালুকদার। তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

শুধু রেলের এই দুই কর্মচারীই নন; রেলওয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যারা রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারাও এই টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভিডিও ভাইরাল,রেল,টিকিট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close