গাজী শাহাদত হোসেন ফিরোজী, সিরাজগঞ্জ
পিঁড়িতেই ৫৫ বছর নরসুন্দর দুই ভাই
মানুষমাত্রই সৌন্দর্য পিয়াসী। আর এই সৌন্দর্যের অন্যতম উপকরণ হলো চুল। চুল নিয়ে মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। চুল-দাড়ি কাটা-ছাটা, সেভ করা প্রতিদিন প্রয়োজনীয় কাজের একটি অংশ।
সে কারণেই কেশবিন্যাসের কারিগর নাপিতের প্রয়োজনীয়তা। আগে হাট-বাজারের বটবৃক্ষের ছায়ায়, খেয়াঘাটে, ফুটপাতে কিংবা গ্রামগঞ্জের রাস্তাঘাটে ইটের ওপর সাজানো পিঁড়িতে বসে নাপিতরা গ্রামবাংলার মানুষের চুল-দাড়ি কাটতো।
সে সময়ের মালই ছাট, নাইড়া, দিলিপ ছাট, হাপ ছাট, গোল ছাট, টেডিছাট চুল কাটার নাম বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞাত। এভাবে পিঁড়িতে বসিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের চুল-দাড়ি কাটার সেই পরিচিত দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না।
তাছাড়াও প্রতিটি গ্রামের পাড়ায়-মহল্লায় নরসুন্দরদের কান ফাটা আহ্বান এই যে ভাই অ্যাইসা গেছি, চুল কাটতে তাড়াতাড়ি অ্যাইসেন। কালের আর্বতে এমনি প্রচারও বন্ধ হয়ে গেছে। সভ্যতার বির্বতনে মানবজীবনের গতিধারায় এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। জেন্টস পার্লারগুলোতে বাহারি রংঙের হেয়ার স্টাইলের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে হাট-বাজারে পিঁড়িতে বসা অতীতের ‘হাঁটু সেলুন’।
তবে হাঁটু সেলুনে দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে চুল কেটে চলেছেন দুই ভাই সুকুমার শীল (৭৫) সুবাস শীল (৬৫)। এরা দুই ভাই চৌহালী উপজেলার খামার গ্রামের বাসিন্দা।
সুবাস শীল ও সুকুমার শীল বলেন, বাপ দাদার রেখে যাওয়া আদি পেশা আমরা আজও ধরে রেখেছি। পঞ্চান্ন বছর ধরে এই পেশায় আছি। আগে বেতিল বাজারে স্থায়ী কোনো দোকান ছিল না। সপ্তাহে দুদিন শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী পসরা সাজিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। তখন থেকে পিঁড়িতে বসেই চুল ও দাড়ি কাটার কাজ করছি। তখন একজনের চুল কেটে পেতাম ৩ পয়সা এবং দাড়ি ও চুল কাটা দর ছিল ৫ পয়সা। এখন চুল কাটার দর ৩৫ টাকা এবং দাড়ি কাটার দর ১৫ টাকা করে আমরা নেই। এখন প্রতিদিন ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা আয় হয়।
তিনি আরও বলেন, এই পঞ্চান্ন বছরে বাজারের চিত্র বদলে গেলেও আমরা দুই ভাই বদলাইনি। একইভাবে আগের মতোই পিঁড়িতে বসে কাজ করে যাচ্ছি। সুকুমার ও সুবাস শীল আরও বলেন, এই বাজারটা আগের চেয়ে বড় হয়েছে। এখন প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত অবধি ক্রেতাদের ভীড় থাকে।
সুকুমার বলেন, আমার তিন ছেলে একই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তারা মাটিতে নয়, সেলুনে কাজ করে। সুবাস শীলের ১ ছেলে সেও সেলুনে কাজ করে।
তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারাও সেলুনে কাজ করতে চান কি না এমন প্রশ্নে বলেন, পিঁড়িতে বসে কাজ করে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন চাইলেও আর সম্ভব না। জীবনের বাকি দিনগুলো যেটুকু সময় পাই এভাবেই কাজ করে জীবনের ইতি টানতে চাই।
চৌহালী উপজেলার শিক্ষক ইদ্রিস আলী বলেন, সদিয়া ইউনিয়নে তারা দুই ভাই বয়স্ক নরসুন্দর। অল্প টাকায় পিঁড়িতে বসে চুল ও দাড়ি কাটেন এই দুই ভাই। তাছাড়াও কাজিপুর, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই পিঁড়ি সেলুন থাকলেও কালের আবর্তে তাদের কাজ ও আয় অনেক কমে গেছে। তাই অনেকে শীল পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
আজ শুধু শহরের নয়, গ্রাম-বাংলার প্রতিটি হাট-বাজার, অলিতে-গলিতে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক সেলুন। যেখানে সাউন্ড বক্সে বাজতে থাকে মন মাতানো গানের সুর। আর সেলুনগুলো উন্নত ডেকোরেশন আর বাহারি রঙের সাজ সরঞ্জামে সাজানো রয়েছে। এতে অনেক রকম হেয়ার স্টাইল ঝুলানো থাকে। কিছু স্টাইল হয় সেলিব্রেটি, নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড়, ইউটিউবার, ডিজে, টিকটক নামে। ওই স্টাইল দেখে কাটা হয় চুল।