বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি

  ০৯ মে, ২০২২

১৭০ টাকার টিকিট ৭০০ টাকায় বিক্রি করেন স্টেশন মাস্টার

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

মোছাম্মত ছায়েদা (৩৮) স্বামী সন্তানকে নিয়ে থাকেন ঢাকায়। ঈদের ছুটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ইকরতলি গ্রামে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন তিনি। ঈদের পরে ঢাকা যেতে সমস্যায় পড়েন সবসময়ই। এজন্য ছায়েদা গত ৬ দিন আগে একটি ট্রেনের টিকিটের জন্য অগ্রিম বুকিং দিয়ে যান মুকুন্দপুর রেল স্টেশনের মাস্টারের কাছে। মোছাম্মত ছায়েদা শনিবার ৩টা ৪০ মিনিটের সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের ট্রেনে ঢাকা যাওয়ার জন্য স্টেশনে এসে যখন নিয়ম অনুযায়ী বুকিং দেওয়া টিকিট আনতে গেলেন স্টেশন মাস্টারের কাছে তখনই বাধে বিপত্তি। কারণ স্টেশন মাস্টার ১৭০ টাকার টিকিট ৭০০ টাকা ছাড়া দিবেননা। এত টাকা কেন দিতে হবে প্রশ্ন করলে স্টেশন মাস্টার বলেন টিকিট নাই তখন ছায়েদা বলেন আমার বুকিং দেওয়া টিকিট ছিল। কেন এত টাকা দিতে হবে! এমন প্রশ্নের জবাবে স্টেশন মাস্টার টিকিট নাই বলে জানিয়ে দেয়। পরে বাধ্য হয়েই ১৭০ টাকার ট্রেনের টিকিট ৭০০ টাকায় নিতে হয়েছে মোহাম্মদ ছায়েদাকে।

যাত্রীদের অভিযোগ, আগে থেকে টিকিটের জন্য বুকিং দিয়ে রাখলেও কাউন্টারে গিয়ে মাস্টারকে বাড়তি দ্বিগুণ টাকা দিলেই মাস্টার টিকিট দেন নয়তো দেন না।

শুধু মোহাম্মদ ছায়েদা নয় এমন অসংখ্য যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকায় টিকিট বিক্রি করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে অবস্থিত মুকুন্দপুর রেল স্টেশনের টিকিট মাস্টার হুমায়ুন কবির।

স্টেশন সূত্রে জানা যায়, মুকুন্দপুর রেল স্টেশনে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস নামের একটি মাত্র ট্রেন এই স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয়। সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আপ জয়ন্তিকা ট্রেনের মুকুন্দপুরে মোট আসন হলো ২৫টি এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জয়ন্তিকা ডাউন ট্রেনের আসন হলো ২০টি। মুকুন্দপুর স্টেশন থেকে শুধু সিলেটগামী ও ঢাকাগামী আসনের সিট দেওয়া নিয়ম রয়েছে। এছাড়া মধ্যবর্তী কোন স্টেশনের যাত্রাবিরতির কোন আসন দেওয়ার নিয়ম নেই এই মুকুন্দপুর রেল স্টেশনে।

শনিবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সরেজমিন মুকুন্দপুর রেল স্টেশনে ঘুরে বিভিন্ন যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাহাড়পুর ইউনিয়নের বামুটিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান চাকরি করেন সরকারি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে। তিনি গত ৩০ এপ্রিল ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের একটি টিকিটের জন্য বুকিং দিয়ে গেলেও শনিবার স্টেশনে এসে ১৭০ টাকা টিকিট ৪০০ টাকায় নিয়েছেন। কামালমুড়া গ্রামের বাদশা মিয়া ১০ দিন আগে একটি টিকিটের জন্য বুকিং দিয়ে টিকিট নিতে এসেছেন স্টেশনে কিন্তু স্টেশন মাস্টার ৩০০ টাকা রাখলেন। একটি টিকিটে ১৩০ টাকা বেশি নেওয়ায় ক্ষোভ ঝাড়লেন ঢাকায় সিজিডিএফএ সেগুনবাগিচায় চাকরিরত বাদশা মিয়া। ভিটিদাউদপুর গ্রামের সাইফউদ্দিন আহম্মেদ ঢাকাগামী দুইটি আসনের সিট ৩৯০ টাকা দামের টিকিট ৭০০ টাকায় নিতে হয়েছে।

হবিগঞ্জের নোয়াপাড়া থেকে মুকুন্দপুর নানুর বাসায় ঘুরতে আসা শরিফউদ্দিন নামের যাত্রী যাবেন সিলেটে। মুকুন্দপুর স্টেশন থেকে ১৮০ টাকার টিকিট স্টেশন মাস্টার রাখলেন ২২০টাকা।

আবুল কালাম পরিবারের লোকজন নিয়ে স্থানীয় কালাছড়া ঘুরতে এসেছেন। ঘুরে জয়ন্তিকা ট্রেনে মুকুন্দপুর স্টেশন থেকে তিনটি টিকিট নিয়ে শ্রীমঙ্গল নিজ বাড়িতে যাবেন কিন্তু স্টেশন মাস্টার ২৫৫ টাকার তিনটি টিকিট রেখেছেন ৪৫০ টাকা। সময় তখন শনিবার আড়াইটা বাজে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মুকুন্দপুর দাড়ালো তখন মোহাম্মাদ সালেহ (৩৮) নামের একজন ঢাকা থেকে মুকুন্দপুর চাঁনপুর ইউনূছ মিয়ার বাড়িতে এসেছেন ঘুরতে পরিবার নিয়ে। স্টেশন মাস্টার হুমায়ুন কবিরকে আগামী ১৩ তারিখের দুইটি টিকিট বুকিং দেওয়ার কথা বললে স্টেশন মাস্টার এই যাত্রীকে বললেন, টাকা কয়েকটা বাড়িয়ে দিয়েন ব্যবস্থা করে রাখবো। এই কথা বলে মাস্টার খাতায় নাম লেখালেন। কাউন্টার থেকে বের হয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে টিকিট বুকিং কিভাবে দিয়েছেন তখন মোহাম্মদ সালেহ জানান, টিকিট মাস্টার টাকা বাড়িয়ে দিতে বলেছেন তাহলেই টিকিট দিবেন। সালেহ উপায় না পেয়ে নাম লিখিয়েছেন।

স্থানীয় সেজামুড়া গ্রামের বাসিন্ধা ঢাকা হাবিবুল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত সবুজ আহম্মেদ ও ভিটিদাউদপুর গ্রামের বাসিন্ধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিংয়ে মাস্টার্সে পড়ুয়া মোহাম্মদ জুয়েল রানা বলেন, স্টেশন মাস্টার হুমায়ুন কবিরের দুর্ণীতির কারণে সাধারণরা টিকিট পাচ্ছেনা। এই মাস্টার ১০ দিন আগে টিকিট বুকিং দিতে গেলেও বলে টিকিট নাই। আবার যারা বুকিং দিয়ে টিকিট আনতে যায় তাদের কাছ থেকে দ্বিগুণ টাকা রাখেন। তারা জানান, গত দুদিন আগে আমাদের পরিচিত ছোট মনির সিলেট যাবে ১৮০ টাকার টিকিট ৩০০ টাকা রেখেছেন কিন্তু মাস্টার ৩০০ টাকার একই টিকিট দুইজনকে দিয়েছেন। এই ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল হলেও এই কর্মকর্তার কিছুই হবেনা। ছাত্রদের দাবি এই কর্মকর্তা বেশি দাম ছাড়া টিকিট দেয় না। ছাত্ররা বেশি টাকা পাবে কোথায়! এই কর্মকর্তাকে স্টেশন থেকে বিদায় করা নয়তো আন্দোলনে যাবেন ছাত্ররা।

বিজয়নগর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও মুকুন্দপুর গ্রামের বাসিন্ধা রাসেল খান বলেন, স্টেশন মাস্টার হুমায়ুন কবির বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত। এই মাস্টার মাদক সেবন করে সাধারণ মানুষরা বলাবলি করেন। মাস্টার দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি ছাড়া টিকিট দেন না অনেকেই অভিযোগ করে। গত কয়েকদিন আগে মাস্টারকে নিয়ে এই যুবলীগ নেতা ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দেন। স্থানীয় কামালমুড়া গ্রামের রাকিবুল হাসান নামের এক ব্যক্তি ঢাকা ও সিলেটের কুলাউড়া কর্মকর্তাদের কাছে মুখিকভাবে ও লিখিত আকারে স্টেশন মাস্টারের অপকর্মের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।

তারা জানান, বিভিন্ন স্টেশনে কালোবাজারিরা বেশি দামে টিকিট বিক্রি শুনেছি। কিন্তু এই মুকুন্দপুরে স্টেশন মাস্টার নিজেই বড় কালোবাজারি কিন্তু এত অভিযোগ থাকলেও কিসের পাওয়ারে তিনি এখনও আছেন সাধারণ জনগণ সেটা জানেননা।

মুকুন্দপুর রেলস্টেশনের টিকিট মাস্টার হুমায়ুন কবির বলেন, ৭০০ টাকা যেই টিকিটটা রাখা হয়েছে এই টিকিট আমি অন্য স্টেশন থেকে এনে দিয়েছি তাই বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে। সিলেট ও ঢাকা ছাড়া মধ্যবর্তী কোন স্টেশন থেকে টিকিট দেওয়া হয় না আপনি নিজেই বলেছেন তাহলে কিভাবে এনেছেন! টিকিটের গায়ে লিখাও ছিল মুকুন্দপুর থেকে ঢাকা তাহলে ১৭০টাকার টিকিট ৭০০ টাকা কিভাবে রাখলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ট্রেনের সিগনাল দেখবে হবে বলে ও পরে কল দিবেন বলে ফোন কেটে দেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্ব) চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম চৌধুরী জানান, আমার এরিয়া আখাউড়া জংশন পর্যন্ত। আর মুকুন্দপুর স্টেশন ঢাকা এরিয়ায় পড়েছে। তবে, মুকুন্দপুর স্টেশন থেকে ঢাকার এই অল্প সময়ের পথে কীভাবে ১৭০ টাকার টিকিট ৭০০ টাকা বিক্রি হয়— এ খবরে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।

ঢাকার অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপকের নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ট্রেন,যাত্রী,রেল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close