এসএম ইসাহক আলী রাজু গুরুদাসপুর (নাটোর)

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২২

বিলুপ্তির পথে ধান রাখার ‘গোলাঘর’

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

চলনবিলাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে এক সময় সম্ভ্রান্ত কৃষকের উঠোনে উঠোনে শোভা পেত ধান রাখা ‘গোলা ঘর’। সেটি এখন বিলুপ্তির পথে। ‘গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু’আবহমান বাংলার কাব্যিক চরন, যা বর্তমানে প্রবাদ বচন। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এখনো কেউ কেউ বাড়ির উঠানে এই গোলা ঘর রেখে দিয়েছেন।

চলনবিলের গ্রাম-গঞ্জের অবস্থা সম্পন্ন কৃষক তাদের উৎপাদিত ধানসহ অন্যান্য ফসল সংরক্ষণে বাড়ির উঠোনের এক কোনে একটু উঁচু জায়গায় গোলা ঘর স্থাপন করতেন। যাদের জমির পরিমাণ একটু বেশি তারা ধানসহ অন্যান্য ফসলাদি সংরক্ষণের জন্য এই গোলা ঘর ব্যবহার করতেন। বাঁশ দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি গোল আকৃতির কাঠামোই গোলা। গোলা ঘরকৃতির কাঠামোতে এঁটেল মাটির মন্ড তৈরি করে ভেতরে সিই মাটির প্রলেপ লাগিয়ে রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে তার উপরে পিরামিড আকৃতির টিনের চালা দিয়ে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা হতো এই গোলা ঘর। ছোট-বড় মানভেদে এসব গোলায় ১০০ থেকে ৩০০ মণ ফসল সংরক্ষণ করে রাখতেন। চলনবিলের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল প্রথমে রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে গোলায় সংরক্ষণ করতেন। এই গোলাঘর টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতার দাবি কৃষি সচেতন মহলের।

গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের রাবারড্রাম এলাকার কৃষক মোঃ হাসান আলী জানান, এক সময় মাঠভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, আর গোলাভরা ধান গ্রামের সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের পরিচয় বহন করত। সভ্যতার বিবর্তন আর আধুনিক কৃষি সংরক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে হারাতে বসেছে গেরস্থের ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা। আমরা পূর্বপুরষদের ব্যবহৃত সেই ধানের গোলাঘরটি এখনও স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রেখে দিয়েছি।

আব্দুলপুর সরকারি কলেজের ভুগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ হাসেম আলী জানান, সত্তর-আশির দশকের দিকে এসব ধানের গোলাঘর কৃষক ও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল। কারণ এই গোলায় কৃষি ফসল সংরক্ষণে টেকসই হওয়া সাধারণ মানুষ এটাকে সাদরে গ্রহণ করছেন। আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে গোলাঘরটি স্মৃতি হিসাবে এখনো টিকিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে মানুষের পারিবারিক ব্যবহার্য উপকরণে। ফলে প্রযুক্তির দৌড়ে টিকতে না পেরে গোলাঘর এখন বিলুপ্তির পথে। তবে দেশের বিলুপ্তপ্রায় গোলাঘর টিকিয়ে রাখতে কৃষি বিভাগের এগিয়ে আসা দরকার।

গুরুদাসপুর পৌর সদরের আনন্দ নগর গ্রামের কৃষক মোঃ আহাদ আলী বলেন, আশি-নব্বই দশকের দিকে একটা গোলা তৈরিতে খরচ হতো ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন এই পেশাটিও হরিয়ে গেছে। এখন চট বা পলিথিনের বস্তায় ভরে কোনো সময় প্লাস্টিকের ড্রামে ভরে ফসলাদি সংরক্ষণ করা হয়।

গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.হারুনর রশীদ বলেন, বর্তমান সময়ে কৃষকদের আবাদি ও বসবাসের জমির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। তাছাড়া গোলা তৈরিতে জায়গা বেশি লাগে, গোলাকে বায়ুরোধী রাখতে না পারা, গোলা নির্মাণ ও সংরক্ষণ খরচ বেশি, পোকা ও রোগের আক্রমণের সম্ভবনা থাকার কারণে ধানের গোলা এখন গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ের কাছে ঐতিহ্য হারাতে বসা কৃষকের গোলার স্থান দখলে নিয়েছে আধুনিক গুদাম ঘর। সেখানে কৃষকের উৎপাদিত শত শত মণ ফসল সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে বাঁশের চাটায়ে তৈরি ডোল বা গোলাঘর।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নাটোর,গুরুদাসপুর,ধান,গোলাঘর,বিলুপ্তি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close