গাজী শাহাদত হোসেন ফিরোজী, সিরাজগঞ্জ

  ১৮ জানুয়ারি, ২০২২

গাছের ছায়ায় হাঁটু সেলুনে দুই ভাইয়ের ৫৫ বছর

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

অতীতে গ্রাম বাংলার হাট বাজার, বড় বড় বৃক্ষের ছায়ায় বসে চুল-দাঁড়ি কাটার কাজ করতেন নাপিত বা নরসুন্দর সম্প্রদায়। নাপিতরা একটি কাঠের বাক্সে তাদের যন্ত্রপাতি রাখতেন। যার মধ্যে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকারি, পাউডার থাকত। হাট বাজারের নিদিষ্ট স্থানে লাইন ধরে পিড়িতে বসতেন এই নরসুন্দররা। সম্মুখে থাকত গ্রাহকের জন্য অপর একটি পিড়ি।

গলায় সাদা কাপড় পেঁচিয়ে নিজেদের দুই হাঁটুর মাঝে গ্রাহকের মাথা ঢুকিয়ে চুল কাটত। সে সময়ের মালই ছাট, নাইড়া , দিলিপ ছাট, হাপ ছাট, গোল ছাট, টেডিছাট চুল কাটার নাম বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞাত। এভাবে পিড়িতে বসিয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের চুল-দাড়ি কাটার সেই পরিচিত দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। তাছাড়াও প্রতিটি গ্রামের পাড়ায় মহল্লায় নরসুন্দরদের কান ফাটা আহবান এই যে ভাই অ্যাইসা গেছি- চুল কাটতে তারাতারি অ্যাইসেন। কালের আবর্তে এমনি প্রচারও বন্ধ হয়ে গেছে। সভ্যতার বির্বতনে মানবজীবনের গতিধারায় এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে নতুনত্বের ছোয়া। জেন্টস পার্লারগুলোতে বাহারি রংঙের হেয়ার স্টাইলের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে হাট-বাজারে পিড়িতে বসা অতীতের ‘হাঁটু সেলুন’।

তবে হাঁটু সেলুনে দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে চুল কাটছেন দুই ভাই সুকুমার শীল (৭৫) সুবাস শীল (৬৫) এরা দুই ভাই চৌহালী উপজেলার খামার গ্রামের বাসিন্দা। সুবাস শীল ও সুকুমার শীল বলে, বাপ-দাদার রেখে যাওয়া আদি পেশা আমরা আজও ধরে রেখেছি ‘পঞ্চান্ন বছর ধরে এই পেশায় আছি। আগে বেতিল বাজারে স্থায়ী কোনো দোকান ছিল না। সপ্তাহে দুদিন শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী পসরা সাজিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। তখন থেকে পিড়িতে বসেই চুল ও দাড়ি কাটার কাজ করছি। তখন একজনের চুল কেটে পেতাম ৩ পয়সা এবং দাড়ি ও চুল কাটা দর ছিল ৫ পয়সা। এখন চুল কাটার দর ২৫ টাকা এবং দাড়ি কাটার দর ১৫ টাকা করে আমরা নেই। এখন প্রতিদিন ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়।

তিনি আরও বলেন, পঞ্চান্ন বছর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাজারের চিত্র বদলে গেলেও আমরা দুই ভাই বদলাইনি। একইভাবে আগের মতই পিড়িতে বসে কাজ করে যাচ্ছি। সুকুমার ও সুবাস শীল আরও বলেন, এই বাজারটা আগের চেয়ে বড় হয়েছে। এখন প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত ক্রেতাদের ভীড় থাকে।

সুকুমার বলেন, আমরা তিন ছেলে একই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তারা মাটিতে নয় সেলুনে কাজ করে। সুবাস শীলের ১ ছেলে সেও সেলুনে কাজ করে।

আর তাদের দুই ভাইয়ের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেলুনে কাজ করা ইচ্ছা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, পিড়িতে বসে কাজ করে অভ্যস্থ হয়ে গেছি আমরা। এখন চাইলেও আর সম্ভব না। জীবনের বাকি দিনগুলো যেটুকু সময় পাই এভাবেই কাজ করে জীবনের ইতি টানতে চাই।

চৌহালী উপজেলার শিক্ষক ইদ্দ্রিস আলী জানায়, সদিয়া ইউনিয়নের মধ্যে তারা দুই ভাই বয়স্ক নরসুন্দর। অল্প টাকায় পিড়িতে বসে চুল ও দাড়ি কাটেন এই দুই ভাই। তাছাড়াও কাজিপুর, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই পিড়ি সেলুন থাকলেও কালের আবর্তে তাদের কাজ ও আয় অনেক কমে গেছে। তাই অনেক শীল পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

আজ শুধু শহরের নয় গ্রাম-বাংলার প্রতিটি হাট-বাজার ও অলিতে-গলিতে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক সেলুন। যেখানে সাউন্ড বক্সে বাজতে থাকে মনমাতানো গানের সুর। আর সেলুনগুলো উন্নত ডেকোরেশন আর বাহারি রঙের সরঞ্জামে সাজানো। এতে অনেক রকম হেয়ার স্টাইল ঝুলানো থাকে। কিছু স্টাইল হয় সেলিব্রেটি, নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড়, ইউটিউবার, ডিজে, টিকটক নামে। ওই স্টাইল দেখে কাটা হয় চুল। সময়ের সঙ্গে সেলুন পেশার চাকচিক্য ও কদর বেড়েছে। বেড়েছে আয়। কমেছে হাট-বাজারে বটবৃক্ষের শীতল ছায়ার নিচে কিংবা প্রখর রোদে লোহার উঁচু শিখে টানানো ছাতায় ঘেরা পিড়িতে বসা সেলুন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সিরাজগঞ্জ,চৌহালী,নরসুন্দর,পঞ্চান্ন বছর
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close