আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২২

সেচ ও গৃহস্থলির কাজে পানি নিতে বাধা

গামরবুনিয়া খালে অবৈধ বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ

বরগুনার আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের তারিকাটা গ্রামের সরকারি গামরবুনিয়া খালে ৭টি বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে মাচ চাষের নামে গ্রামবাসীদের গোসল, গরু মহিষ চড়ানো, সেচ ও গৃহস্থলি কাজে পানি ব্যাহারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, উপজেলার তারিকাটা মৌজার চাকামইয়ার গামর বুনিয়া দোন খালটি তারিকাটা খাল নামে পরিচিত। এই খালটি কলাপাড়া উপজেলার ইসলামপুর ও গামরবুনিয়া গ্রাম এবং আমতলী উপজেলার তারিকাটা গ্রামের সীমান্ত ভাগ কারী খাল হিসেবেও পরিচিত। এই খালের ভূমির পরিমাণ ২৮ একর। খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই কিলোমিটার।

খালটি তারিকাটা গ্রামের শহীদুল ইসলাম ৩ বছরের জন্য ৭ একর ইজারা নিয়ে কলাপাড়া উপজেলার চাকামইয়া গ্রামের এ্যাডভোকেট মো. হাফিজুর রহমান চুন্নু তালুকদার এবং মো. হাই তালুকদার মিলে মাছ চাষ করছেন।

খালের ওই অংশ বাদে তারিকাটা গ্রামের মফিজ উদ্দিন তালুকদারের ছেলে মেজবহ উদ্দিন ফয়সাল তালুকদার এবং মো. মতিয়ার রহমান তালুকদারের ছেলে মো. আরিফুর রহমান তালুকদার ইজারা ছাড়াই ২১ একর এফসিডিআই (ফ্লাড কন্টোল ড্রেনেজ এন্ড ইন্টিগ্রেটেড) প্রকল্পের আওতায় খনন করা খাল দখল করে মাছ চাষ করছেন।

মাছ চাষের জন্য তারা প্রবহমান খালের ৭টি স্থানে বাঁধ নির্মান করেন। খালটির পশ্চিম অংশে আমতলী-তালতলী সড়কের তারিকাটা বাজার নামক স্থানে পানি প্রবাহের জন্য বহু পূর্বে নির্মিত কালভার্টের মুখে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ সম্পূর্ন বন্ধ করে দেন।

খালটিতে পানি আটকিয়ে মাছ চাষ করায় আমতলী উপজেলার তারিকাটা, কলাপাড়া উপজেলার ইসলামপুর ও গামরবুনিয়া গ্রামের প্রায় ৫ হাজার মানুষ খালটির পানিতে গোসল ও গৃহস্থিলী কাজের জন্য হারিপাতিল ধোয়ার কাজও করতে দিচ্ছে না।

এমনকি খালে গবাদিপশুকে পানি পানের জন্যও নামতে দিচ্ছে না। খালের পানির উপর নির্ভর করে এই গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক বোরোধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য পানির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কৃষকের ইরি বোরো এবং রবি মৌসুমে সেচ কাজের জন্য এই খালের পানি ব্যবহার করতে দিচ্ছে না মাচ চাষীরা। ফলে গামরবুনিয়া খালের পারে বসবাসরত তারিকাটা এবং ইসলামপুর ও গামরবুনিয়া গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক বোরোধানসহ রবি ফসল চাষ করতে পারছে না।

খাল দখল করে মাচ চাষের ফলে বাতাসের সময় আবদ্ধ পানির ঢেই এবং তেলাপিয়া মাছের মাটি ঠোকরে প্রতিনিয়ত খালের তারিকাটা অংশের সড়ক ধসে মূল্যবান গাছপালা খালের পানিতে ধসে পড়েছে।

তারিকাটা গ্রামের কৃষক মো. সুলতান গাজী জানান, শহীদুল ইসলাম গাজী, এ্যাডভোকেট মো.হফিজুর রহমান চুন্নু তালুকদার, মো. হাই তালুকদার, মেজবাহ উদ্দিন ফয়সাল তালুকদার, মো. আরিফ তালুকদারসহ স্থানীয় প্রভাব শালীরা গামরবুনিয়া খালে ৭টি বান দিয়া হ্যারা মাছ চাষ করছে। হেগো ভয়তে খালে কেউ নাইতে পারে না। গরু বাছুরেরে পানি খাওয়াইতে পারে না। এই খালে গোনে ধান লাগানের লইগ্যা কেউরে পানি নিতে দেয় না। কেউ প্রতিবাদ করলে হ্যারে মামলা দিয়া হয়রানি করে।

তারিকাটা গ্রামের ষাটোর্ধ নারী সাজেদা বেগম বলেন, বাবা মোরা এই খালে নামতে পারি না। গোসল করতে দেয় না। আরি পাতিল ধুইতে দেয় না। আরেক নারী নাজমা বেগম বলেন, এই খালের পানির বদলে মোরা ডোবা নালায় গোসল করি। আবার রান্দার জন্যও এই ডোবার পানি ভাতে ও সালুনে (তরকারীতে) দেই।

তারিকাটা গ্রামের আল আমিন নামে এক যুবক বলেন, মাছ চাষের জন্য এই গ্রামের রাস্তা ঘাট বলতে কিছু নাই। খালে মাছ চাষের ফলে রাস্তা ভাইঙ্গা খালে বিলীন অইয়া গ্যাছে।

মাছ চাষী শহীদুল ইসলাম গাজী বলেন, মোরা ২০১৯ সাল থেকে ৩ বছরের জন্য ৭ একর খাল ইজারা নিয়া মাছ চাষ করছি। এবছর আমাদের ইজারার মেয়াদ শেষ হবে। তিনি গ্রামবাসীদের পানি ব্যাবহারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। আরেক মাছ চাষী মেজবাহ উদ্দিন ফয়সাল তালুকদার বলেন, খালের পানি ব্যবহার কাউকে বাধা দেওয়া হয় না। ইজারা না নিয়ে কিভাবে মাছ চাষ করেছেন এ প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেন, ইজারা পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে।

তারিকাটা গ্রামের ইউপি সদস্য মো. জসিম উদ্দিন বলেন, গামরবুনিয়া প্রবাহমান খালে ৭টি বাঁধ এবং কালভার্টের মুখ বন্ধ করে মাছ চাষ করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে এই গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ গামরবুনিয়া খালে নামতে পাছেনা। ইরি বোরো এবং রবি মৌসুমে ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ কাজেও এই খালের পানি ব্যবহার করতে পারছে না গ্রামবাসী। গ্রামবাসীরা খালে গোসল এবং গরু মহিষেরে পানি খাওয়াতে গেলে এবং মহিলারা হাড়ি পাতিল ধুইতে গেলে তাদের তারাইয়া দেয় মাছ চাষীরা। তিনি এই খালটির মাছ চাষ বন্ধ করে গ্রামবাসীর জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানান।

খালের পারে অবস্থিত কলাপাড়া উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের আবুল কালাম বলেন, গামরবুনিয়া খালে মাছ চাষের ফলে গ্রামবাসী এই খালের পানি ব্যবহার করতে পারছে না। ইরি বোরো ধানে সেচ কাজের জন্যও তারা পানি ব্যবহার করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ইজারা বাতিল করে তিনি খাল গ্রামবাসীদের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানান।

আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সোহেলী পারভীন মালা বলেন, ইজারা ছাড়া প্রভাবশালীরা গামরবুনিয়া খাল দখল করে ৭টি বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে মাছ চাষ করছে। তারা প্রভাব খাটিয়ে গ্রামবাসীদের খাল থেকে সেচের জন্য, গৃহস্থলি ও গোসল করতে পানি দিচ্ছে না। এমনকি তারা খালে গরু মহিষের পানি পর্যন্ত খাওয়াতে দিচ্ছে না। এই খালটি গ্রামবাসীদের কথা চিন্তা করে উম্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য প্রশাসনের নিকট দাবী জানাই।

আমতলী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হালিমা সর্দার বলেন, এই খালের ৭ একর ৩ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। আর বাকি ২১ একর এখনো কোনো ইজারা দেওয়া হয়নি। তিনি আরো বলেন, সেচ কাজে পানি নিতে কোন কৃষককে বাধা দেওয়া যাবে না।

আমতলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, গামরবুনিয়া খালের বিষয়টি সরেজমিনে দেখে অনিয়ম পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আমতলী,বরগুনা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close