সালাহ্উদ্দিন শুভ, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)

  ১২ জানুয়ারি, ২০২২

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঢেঁকি। বাংলার গ্রামীণ রমণীরা ধান ভানা, হলুদকুটা, মটরশুঁটি, ডাল কুটা ও পৌষ-পার্বনে পিঠা তৈরির জন্য চালের গুঁড়া কুটার জন্য ঢেঁকি ব্যবহার করতেন। এখন আর গ্রাম-বাংলায় ঢেঁকি দেখা যায় না বললেই চলে।

অতীতে গ্রাম-বাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ধান থেকে চাল তৈরির জন্য কিংবা চালের আটা তৈরির জন্য একমাত্র ঢেঁকিই ছিল ভরসা। প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে। তখন বাংলার ঘরে ঘরে ধান ভানা, চিড়া কুটা, চালের গুঁড়া করার জন্য ঢেঁকিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ঢেঁকি গৃহস্থের সচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির কাছে ম্লান হয়ে গেছে আগেকার দিনের সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকির ব্যবহার। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার ইউপির জালালপুর গ্রামের ইউপি সদস্য মো. সালাহ্উদ্দিনের বাড়ির উঠানে একটি ঢেঁকি পাতানো দেখতে পাওয়া যায়।

৮০-৯০ দশকে জেলার গ্রাম এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের সারা বছরের ভাতের চাল বাড়িতে পাতানো ঢেঁকিতে ছেঁটে প্রস্তুত করত। ভাদ্রমাসে আউস ও অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে রোপা আমন ধান ঘরে উঠলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নানা রকম পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। আর এজন্য বাড়িতে বাড়িতে আটা কোটার ধুম পড়ে যেত।

আমন ধান কাটা শেষে পৌষ মাসে ঢেঁকিতে ধান ভাঙার শব্দে অনেকের রাতের ঘুম নষ্ট হতো। আবার ভোর বেলা ঢেঁকির শব্দে অনেকের ঘুম ভাঙত। ধান ভেঙে চাল ছাঁটার জন্য মহিলারা আবার কখনও মহিলার পাশাপাশি পুরুষরাও ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভাঙত। দুইজন মহিলা সারাক্ষণ ঢেঁকিতে পাড় দিত আর একজন ঢেঁকির আগায় বসে শুকনো ধানগুলোকে উনুতে (ভাঙার গর্তে) এগিয়ে দিত। এভাবেই সারা রাত ধরে গ্রামের গৃহবধূরা তাদের সারা বছরের চাল ঢেঁকিতে ছেঁটে মাটির কুঠি কিংবা বাশেঁর তৈরি ডোলে ভরে সারাবছরের জন্য সংরক্ষণ করে রাখত। সে সময় ঢেঁকি ছাটা চালের ভাত খেয়ে অধিকাংশ মানুষই যেমন তৃপ্তি পেত, তেমনি সুস্থ জীবনযাপন করত। বর্তমানে আধুনিক যুগে চাকচিক্কের আধিক্যে হারিয়ে গেছে সেই ঢেঁকি ছাটা চাল। এখন পাড়ায় পাড়ায় ধান ভাঙা, হাসকিং মিল, এমনকি ভ্রাম্যমাণ মিল প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ভেঙে দেয়ায় ঝকঝকে চাল, খাটুনি কম ও সময় সাশ্রয় হওয়ায় ঢেঁকি আর কোথাও চোখে পড়ে না।

অপরদিকে, চালের আটা তৈরির জন্য কিছুদিন আগেও কয়েকটি পাড়া মিলে দু’একটি ঢেঁকি চোখে পড়তো। কিন্তু এখন শুকনো ভেজা উভয় প্রকার চালের আটা মেশিনে তৈরি হওয়ায় আদিকালের সেই ঢেঁকিগুলো জেলার অনেক গ্রামেই খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে।

ঢেঁকিতে আটা প্রস্তুত করার সময় নারী রাজিয়া ও সুনিয়া বেগম বলেন, মেশিনের তৈরি আটা দিয়ে সকল প্রকার পিঠা তৈরি তেমন ভালো হয় না। তাই অনেক সময় অনেক কিছু খাবার জিনিস তৈরি করতে হলে এখনও ঢেঁকির তৈরি আটা লাগে। তাই কালের সাক্ষী হিসেবে সে তাদের উঠানে ঢেঁকিটি এখনো পেতে রেখেছেন। বছরে অন্তত দু’এক বার তারা ও পাড়ার অনেকেই এই ঢেঁকিতে এসে আটা তৈরি করে থাকে। তবে আগেকার দিনের মতো ঢেঁকির আর কদর নেই। কোনোদিন হয়তো সেও ঢেঁকিটি তুলে ফেলবেন। কালের বিবর্তনে গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকির হয়তো আর দেখাই মিলবে না। আর কিছুদিন পরে নতুন প্রজন্ম হয়ত ঢেঁকির কথা শুনলে সেটি কী জিনিস, তা বুঝানো মুশকিল হয়ে পড়বে। তাই বাংলার গ্রামের ঐতিহ্য ঢেঁকিকে স্মরণ করাতে হলে জাদুঘরে ঢেঁকি সংরক্ষণ করে রাখা উচিত বলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ মনে করেন।

তবে স্থানীয়রা বলেন, ঢেঁকি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। যখন যন্ত্রচালিত ধান ভানা কল ছিল না তখন ঢেঁকির কদর বেশ ছিল। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে এখন পুরোপুরি ঢেঁকি বিলীন হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, সরকারি বা বেসরকারিভাবে হারানো ঐতিহ্যগুলো নিয়ে বিশেষ মেলার আয়োজন করলে বর্তমান প্রজন্ম ঢেঁকিসহ হারানো ঐতিহ্যগুলো চিনতে পারবে এবং তা রক্ষায় এগিয়ে আসবে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কমলগঞ্জ,গ্রাম-বাংলা,ঐতিহ্য,ঢেঁকি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close