মো. শাহ আলম, খুলনা

  ২৩ নভেম্বর, ২০২১

যেখানে মিঠা পানি সংগ্রহেই নারীদের সময় পার!

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয় খুলনার কয়রায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের। এতে এলাকাটিতে স্থায়ীভাবে চেপে বসেছে লবণাক্ততা। লবণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে দেখা দিয়েছে মিঠা পানির তীব্র সংকট। তাই নারীদের প্রতিনিয়ত দুই থেকে তিন মাইল দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।

নৃ-গোষ্ঠীর সূত্র অনুযায়ী, তাদের বাপ ঠাকুরদাদারা মহাবলী রাজার অধীনে রাচি, বিরভূম, চব্বিশ পরগণা, মেদেনীপুর প্রভৃতি জেলায় থাকতেন। ২৫০ থেকে ৩শ’ বছর আগে এখানকার জমিদাররা তাদের নিয়ে আসেন আবাদ করার জন্য এবং বলেন, আবাদ হয়ে গেলে ফেরত পাঠাবেন। কিন্তু তাদের আনার পর জমিদাররা তাদের নামের সাথে সর্দার উপাধি যোগ করে দেন। আর তখন থেকেই তাদের বাপ-ঠাকুরদাদারা এখানে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে এ উপজেলার সদর ইউনিয়ন, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশিতে বসবাস করছে প্রায় ১২শ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (মুন্ডা ও মাহতো) মানুষ।

জানা গেছে, উজানের পানি কমে যাওয়া, নদী-সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা দুর্যোগে ওই অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। লবণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মিঠা পানির চরম সংকট দেখা দিচ্ছে। তাই এখানকার নারীদের প্রতিদিন প্রায় ৩-৬ ঘন্টা ব্যয় করে দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। কৃষিতে দক্ষ এ সকল নারীরা দিনের একটি বড় অংশ খাবার পানি সংগ্রহে ব্যয় করতে হয়। সঙ্গত কারণে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক কাজে সময় দিতে পারে না। অন্যদিকে নারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে দিন দিন এ গোষ্ঠীর সংখ্যা কমছে।

২নং কয়রার বাসিন্দা কবিতা মুন্ডা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতিদিন জোয়ারের সময় আমার ঘরের মধ্যে পানি উঠে যায়। ভাটায় নেমে যায়। এভাবে জীবন চলছে। সরকারি সহযোগিতা তৃণমূল পর্যন্ত সঠিকভাবে পৌঁছায় না।

বড় বাড়ির বাসিন্দা সুমিত্রা মুন্ডা বলেন, আমরা অবহেলিত এলাকায় থাকি। হাসপাতাল অনেক দূরে। রাস্তাও খারাপ। তাই ধাত্রীই গর্ভবতীদের ভরসা। ধাত্রী না পারলে গ্রাম্য ডাক্তার। এরপর কমিউনিটি ক্লিনিক। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সেবার মান বাড়ানো দরকার। যেন গর্ভবতী ও বয়স্করা সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে পারে। এছাড়া ধাত্রী যারা আছেন তাদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দরকার।

সাধনা মুন্ডা বলেন, এসব অঞ্চলে রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। পুকুরেও নোনা পানি। তাদের বাড়ির চারপাশে রয়েছে প্রভাবশালীদের নোনা পানির বাগদা চিংড়ি ঘের। দুই থেকে তিন মাইল দূর থেকে প্রচুর কষ্ট করে মহিলাদেরকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। একেক জন মহিলা মাথায় একটা কলসি, মাজায় একটা এবং হাতে একটা মোট তিনটি পাত্রে করে পানি আনে।

মাঝের আইট-এর বাসিন্দা বাসন্তি মুন্ডা বলেন, প্রায়ই পেটে সমস্যা থাকে। সারাদিন লবণ পানিতে কাজ করায় তার চামড়ায় সাদাটে ঘা হয়ে গেছে।

হরিহরপুর গ্রামের বাসিন্দা আলোমনি মাহাতো বলেন, প্রতিদিন জোয়ারের সময় গ্রামে পানি উঠে যায়। ফলে নারীদের গোসল ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, দীর্ঘদিন লোনা পানি ব্যবহারে ডায়রিয়া, অমাশয়, চর্মরোগ ও গর্ভকালীন নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ (আইআরভি)’র নির্বাহী পরিচালক মেরিনা যুথী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকলীয় অঞ্চলের অন্যতম একটি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা কয়রা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে এ এলাকার মানুষেরা লড়ছে প্রতিনিয়ত। দুর্যোগের কারণে এখানকার নারীরা চর্ম রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বাতের ব্যাথা, গর্ভকালীন সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। কিন্তু স্বল্প আয় ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দূরে থাকায় তারা খুব সহজে যেতে পারেন না। স্বাস্থ্য কর্মীরাও কখনও তাদের গ্রামে তেমন যায় না। কিন্তু এসডিজি লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে হলে পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত নারীদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সংযুক্ত করতে হবে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র জানান, ওই অঞ্চলকে আমরা বেশি লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছি। এসব জায়গায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পুকুর খনন করা হচ্ছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
খুলনা,মিঠা পানি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close