মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ১৭ নভেম্বর, ২০২১

চোখে আনন্দ, মুখে হাসি

বিকলাঙ্গ শাহিদার স্বপ্নের প্রতিবন্ধী স্কুলের যাত্রা শুরু

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

দুটি পা ও একটি হাত বাদেই জন্ম নেওয়া প্রতিবন্ধী শাহিদা খাতুন (৩০) বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি (অনার্স-মাস্টার্স) অর্জন করার পরও জোটেনি বিশেষ কোটায় কোনো সরকারি বা বেসরকারি চাকরি। তবে থেমে যাননি তিনি। নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সমাজ উন্নয়নে বিভিন্ন সেবামূলক কাজকর্মের জন একাধিক বার ‘জয়িতা’ সম্মাননা পেলেও আলোর দিশা মেলেনি তার অন্ধকারময় জীবনে। হতাশার শেষ সময়ে শাহিদার স্বপ্ন ছিলো একটি প্রতিবন্ধী স্কুল করা। যেখানে হতাশাগ্রস্ত সমাজের বিশেষ প্রতিবন্ধী নারী পুরুষের পাশাপাশি বয়স্কদের বিনামূল্যে লেখাপড়া ও হস্তশিল্পের কাজের প্রশিক্ষণ দেবেন তিনি। কেউ এগিয়ে না এলেও দেশসেরা উদ্ভাবক শার্শার কৃতি সন্তান মিজানুর রহমান স্কুল নির্মাণে এগিয়ে আসেন। প্রতিবন্ধী স্কুলের কাজ শেষ হওয়ায় চোখে রঙিন স্বপ্ন আর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটেছে তার।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের মুদি দোকানি রফিউদ্দিনের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ শাহিদা। ১৯৯১ সালে শাহিদার জন্ম হলে গোটা পরিবারে যেন আঁধার নেমে আসে। কারণ, মেয়েটির একটি হাত ও দুটি পা নেই। একটি মাত্র হাত (বামহাত) দিয়েই করতে হয় তার সমস্ত কাজ। শাহিদার মা শিমুলিয়ার খ্রিস্টান মিশনে হাতের কাজ করতে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন শাহিদাকে। সেখানেই মিশনের সিস্টার জোসেফ মেরী তাকে হাতেখড়ি দেন। শাহিদার বয়স পাঁচ বছর হলে সেন্ট লুইস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে নিয়ে যান, কিন্তু প্রতিবন্ধী হওয়ায় স্কুলের শিক্ষকরা তাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে জোসেফ মেরীর বদৌলতেই সুযোগ হয় স্কুলে পড়ার। কখনও মা-বাবা, কখনও ভাই-বোনের কোলে চড়ে স্কুলে যাতায়াত শুরু হয় শাহিদার। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় কোনো কিছুই তাকে স্কুল থেকে দূরে রাখতে পারেনি। এভাবেই ২০০৭ সালে সেন্ট লুইস হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও ২০০৯ সালে শিমুলিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। যশোর সরকারি এমএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ২০১৫ সালে এমএ পাশ করে শাহিদা। অসম্ভবকে সম্ভব করেই তিনি প্রমাণ করেছেন অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে অসম্ভব বলে কোন কিছু নেই। কারো দয়া ও অনুগ্রহ নয়, আত্মনির্ভরশীল হয়েই এগিয়ে যেতে চান শাহিদা। প্রতিবন্ধী শিশু ও নারীদের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান।

শাহিদার বাবা রফিউদ্দিন বলেন, শাহিদা ছোট বেলায় সবসময় হতাশ থাকত। তার কোনো খেলার সঙ্গী ছিলো না। শুধু মাত্র বিকলাঙ্গ (প্রতিবন্ধী) হওয়ায় অন্য বাচ্চারা তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকতো। সে এক নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করত। তাঁর সহপাঠী ও সমবয়সীরা পায়ে ভর দিয়ে দৌঁড়াতো, খেলতো, নাচতো, ছুটতো, সাঁতার কাটতো। কিন্তু এর কোনকিছুই যখন সে করতে পারতো না, তখন সে মনস্থির করলো এই জীবন যখন অন্য জীবনের মতো চলবে না তখন এই জীবনকে অন্যভাবে গড়তে হবে। তখন সে পড়ালেখা শুরু করল। যেহেতু সে নিজে চলাফেরা করতে পারেনা তাই উদ্ভাবক মিজানুর রহমান তাকে একটা হুইল চেয়ার দেওয়ায় এখন সে মুটামুটি চলাফেরা করতে পারে।

শাহিদা খাতুন বলেন, আমরা ছয় ভাই বোন। আমি ভাই বোনের মধ্যে চার নম্বর। আমার আব্বু মুদির ব্যবসা করেন। প্রতিবন্ধী হিসেবে নিজেকে সমাজের বোঝা হিসেবে বাঁচতে চাইনি। তাই পড়ালেখা শুরু করি। ‘প্রতিবন্ধী ভাতা’ ছাড়া সরকারি বেসরকারি কোন সহায়তা পাইনি। তাপরও কঠিন প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে দেখিয়ে দিয়েছি ‘আমরাও পারি’।

শাহিদা বলেন, ২০১৫ সালে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বেকার জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে শিখেছি হস্তশিল্প ও কুঠির শিল্পের নানান কাজ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় হয়নি কোন সুযোগ সুবিধা। এমন কী সরকারি কোটায় চাকরির আশা থাকলেও তা ভাগ্যে জোটেনি। বয়সসীমাও পার হতে আর মাত্র একটি বছর বাকি তাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। দিনের পর দিন যখন সকল আশা ভরসা ব্যর্থ হতে চল্লো ঠিক তখনই নিজ গ্রামে একটি প্রতিবন্ধী স্কুল গড়ে তুলতে সহযোগিতা চেয়েছিলাম সমাজের বিত্তশালী ও বিবেকবান মানুষের কাছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। সর্বশেষ শার্শার দেশসেরা উদ্ভাবক মিজানুর রহমান প্রতিবন্ধী স্কুল গড়ার উদ্যোগ নিয়ে প্রাথমিক কাজটি শেষ করেছেন। মাটিতে বসে শিশুদের ক্লাশ শুরু করেছি। এখনো অনেক কিছু বাকী। প্রতিবন্ধী স্কুলের জন্য চেয়ার, বেঞ্চ, ফ্যান, বিদ্যুৎ, টয়লেট, পানির ব্যবস্থাসহ প্রতিবন্ধী শিশু ও বয়স্কদের জন্য চাই পরিবহনের সুবিধা।

উদ্ভাবক মিজানুর রহমান বলেন, শাহিদা একজন প্রতিবন্ধী হলেও একটি মাত্র হাতে ভর করে লেখাপড়ার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছে। চাকরি না পেয়ে যখন সে হতাশ হয়ে পড়ে তখন এটা আমার নজরে আসে। তার স্কুল তৈরির কথা আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করলে অনেকেই সহায়তা দিতে চায়। সবার সহায়তায় কাজটি আমি এগিয়ে নিয়েছি। শাহিদার স্কুল তৈরির স্বপ্নকে যারা বাস্তবায়ন করতে অর্থায়ন করেছেন তাদের প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ। বাঁশ খুঁটি টিন দিয়ে ঘরটি তৈরি করা হয়েছে। ছোট ছোট শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।

শাহিদার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই স্কুলে শুধু প্রতিবন্ধী শিশুরাই নয়, বয়স্ক ও বিধবা নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করবো। শিক্ষিত প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের শতভাগ সুযোগ থাকবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এখানে প্রতিবন্ধীরা হস্তশিল্প ও কুঠির শিল্পের নানান কাজ শিখে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে।

তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সারাদেশে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় চালু হয়েছে। সরকার যাচাই বাছাই করে স্কুলগুলোর অনুমোদন দিলে প্রতিবন্ধীদের উপকার হত। সেখানে যেমন শিক্ষিত প্রতিবন্ধীদের চাকরি হতো। কর্মসংস্থান হত। আবার প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষিত হত। এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিক হওয়া দরকার।

প্রতিবন্ধী দেখলেই মানুষ মনে করে তার দিয়ে কাজ হবে না। কিন্তু মানুষ তাকে কাজ দিয়ে বলে না তুমি করে দেখাও। সেই সুযোগ দিলে কিন্তু সে পারবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।

অদম্য মেধাবী মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করা শাহিদার শেষ স্বপ্ন প্রতিবন্ধী স্কুল সুষ্ঠুভাবে পরিচলনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন শাহিদা খাতুন। শাহিদা খাতুনের বিকাশ নম্বর-০১৭৪৭১৫৪১৬০।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বেনাপোল,প্রতিবন্ধী,শাহিদা,জয়িতা,প্রতিবন্ধী স্কুল,যাত্রা শুরু
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close