বেনাপোল প্রতিনিধি

  ১০ অক্টোবর, ২০২১

বেনাপোল বন্দরে ৬ কিলোমিটার যানজট, ভোগান্তিতে ব্যবসায়ীরা

দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ যানজট। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ী, পথচারীসহ ভারত গমনাগমনকারী পাসপোর্টধারী যাত্রীরা।

উভয় দেশে ট্রাক টার্মিনাল না থাকায় বেনাপোল বন্দরে আসা পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে সড়কের ওপর রাখেন চালকরা। এতে ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে যানজট। একমাস ধরে বেনাপোল বন্দরে রপ্তানির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দুই হাজার পণ্যবাহী ট্রাক। ফলে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জরুরি কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রপ্তানির চাপে প্রতিদিন প্রায় ১০০ ট্রাক পণ্য আমদানি কমে গেছে। দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা এসব গাড়ির তেল, ব্যাটারি, মালামাল, কাগজপত্র, মোবাইল, ম্যানিব্যাগ ও টাকা-পয়সা চুরি যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক শ্রেণির নাইট গার্ড পরিচয়ে চাঁদাবাজির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। দিতে হচ্ছে টাকা, না দিলে মারধরের শিকারও হচ্ছেন তারা। এই অবস্থার উত্তরণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মধ্যে রপ্তানি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বেশি রপ্তানি পণ্যের ট্রাক না নেওয়ায় এখানে যানজট শুরু হয়েছে। এছাড়া হঠাৎ করে রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় ও পণ্যবাহী ট্রাক বেশি আসায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রোপোল বন্দরের জায়গা সংকটের কারণ দেখিয়ে বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ভারত।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হচ্ছে। ভারত প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ৩৫০ থেকে ৪০০ ট্রাক পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করলেও বাংলাদেশি পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বরাবরই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ভারত আগে ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাক রপ্তানি পণ্য গ্রহণ করলেও বর্তমানে ১০০ থেকে ১২০ ট্রাক রপ্তানি পণ্য গ্রহণ করছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা বিরাজ করলেও প্রশাসনের কোন কর্তাব্যক্তিকে তা নিরসনে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। দফায় দফায় আলোচনা করেও কোন সুরাহা করা যায়নি যানজটের। এতে রপ্তানি বাণিজ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিন এক একটি ট্রাককে পণ্য পরিবহনের ভাড়ার পাশাপাশি দুই হাজার টাকা করে ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে। সময়মতো এসব পণ্যবাহী ট্রাক গন্তব্যে যেতে না পারায় লাখ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এদেশের রপ্তানিকারকরা। এ নিয়ে বন্দর ও আশেপাশের এলাকায় বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থ বছরে রপ্তানি বেড়েছে কয়েকগুন। ২০২০-২১ অর্থ বছরের জুলাই মাসে বেনাপোল দিয়ে ভারতে রপ্তানি হয় ২৭৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা মূল্যের ২৬ হাজার ৩৫ মে. টন পণ্য। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮৪ কোটি ৩ লাখ টাকা মূল্যের ২৪ হাজার ৭১০ মে. টন পণ্য। ২০২০-২১ আগস্ট মাসে রপ্তানি হয় ২৫৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা মূল্যের ২৩ হাজার ১১৫ মে. টন পণ্য। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের আগস্ট মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪০ কোটি ৯২ লাখ টাকা মূল্যের ৩০ হাজার ৩৯৩ মে. টন পণ্য। ২০২০-২১ সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি হয় ৬০০ কোটি ৮১ লাখ টাকা মূল্যের ৩৯ হাজার ৩৮৩ মে. টন পণ্য। সর্বশেষ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৩২ কোটি ১৬ লাখ টাকা মূল্যের ৭৭ হাজার ৩৫০ মে. টন পণ্য। গত বছর থেকে এ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৪৩ হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন পণ্য।

বেনাপোল ট্রাক-লরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহীন জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে সয়াবিনের ভূষি, পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং গার্মেন্টস, সাবান, ব্যাটারি, গার্মেন্টস ঝুট ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিদিন এসব পণ্য নিয়ে ২০০-২৫০ ট্রাক ভারতে প্রবেশের জন্য বেনাপোল বন্দরে আসছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ১০০ থেকে ১২০টি ট্রাক গ্রহণ করছে। এ কারণে বেনাপোল বন্দর এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া বেনাপোল বন্দরে রপ্তানি পণ্যের ট্রাক রাখার কোনও টার্মিনাল নেই।

আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৫০ ট্রাক তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে দ্রুত রপ্তানি করা সম্ভব হলেও বর্তমানে যানজটের কারণে তা কঠিন রূপ নিয়েছে। এছাড়া ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি পণ্য গ্রহণে ধীরগতি নীতি অনুসরণ করায় রপ্তানি বাণিজ্যে সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। এর ফলে আমদানি করা পণ্য আসতে অনেক দেরি হচ্ছে।

ইন্দো-বাংলা চেম্বার অফ কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে আগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের মালামাল আমদানি হতো। বর্তমানে এই আমদানির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে। রপ্তানি পণ্য নিয়ে কয়েক হাজার ট্রাক সড়কের উপর দাঁড়িয়ে আছে দিনের পর দিন। বন্দরের এ অবস্থা চলতে চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি দেশে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের সংকট তৈরি হবে। বন্ধ হতে পারে শিল্প কলকারখানা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনই যদি দ্রুত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে দু’দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুন। কিন্তু বন্দরের অবকাঠামো বাড়েনি। রপ্তানি পণ্যের ট্রাক রাখার কোন টার্মিনাল না থাকায় প্রধান সড়কসহ আশেপাশের সড়কে ট্রাক রাখার ফলে বেনাপোল বন্দর এখন কার্যত অচল। এছাড়া আগামী কয়েকদিন পর শুরু হবে দুর্গাপূজার ছুটি। এজন্য হঠাৎ রপ্তানি বেড়েছে। ভারত থেকে আসা ট্রাক বেনাপোল বন্দরের পার্কিংয়ে থাকলেও রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক রাস্তায় রয়েছে। যানজট কতদিন থাকবে তা বলা মুশকিল।

কয়েকজন ট্রাকচালক জানান, কেউ কেউ ২০ দিন থেকে এক মাস তারা রাস্তায় রয়েছেন। প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মালামাল চুরি হচ্ছে ট্রাক থেকে। চাঁদাবাজি চলছে। টাকা না দিলে মারপিটও করে এক শ্রেণির লোকজন। ভারতে ধীরগতিতে গাড়ি প্রবেশ করছে। অবস্থার উত্তরণে দ্রুত ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের জোর দাবি জানান তারা।

বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক মামুন কবির তরফদার বলেন, ভারতের পেট্রাপোল বন্দর হয়ে পণ্য আমদানি বাড়ার পাশাপাশি পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে দ্বিগুণ। শত শত পণ্য বোঝাই ট্রাক ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় বেনাপোল বন্দর, বন্দরের আশেপাশে ও প্রধান সড়কে অবস্থান করছে। এতে বন্দর এলাকায় আমদানি-রপ্তানি পণ্য খালাস ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, রপ্তানি বাণিজ্য আরও গতিশীল করতে সম্প্রতি ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু ওপারের টার্মিনালে জায়গা না থাকায় তারা বেশি ট্রাক নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও প্রতিদিন যাতে বেশি বেশি ট্রাক পণ্য ভারতে রপ্তানি করা যায় সে বিষয়ে আমরা রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছি।

বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমদানি বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াও।

তিনি বলেন, হঠাৎ করে রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় ট্রাকের চাপে আমদানি বাণিজ্যও কমে গেছে। এতে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বেনাপোল,যানজট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close