গাজী শাহনেওয়াজ, সাতক্ষীরা (শ্যামনগর) থেকে ফিরে
ভিটেমাটি ছেড়ে নতুন আশ্রয়ে
‘যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের উপকূলীয় মানুষের। তাদের কষ্টগুলো কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণের সঙ্গে যারা খাপ খাইয়ে চলতে পারছে না তারা পাড়ি দিচ্ছে অজানার উদ্দেশে। ভিটেমাটি নদীতে হারিয়ে তারা এখন একরকম বাস্তুচ্যুত।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের বাসিন্দা রোকসানা পারভীন আমুলিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি বলেন, খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত। পানিতে তলিয়ে আছে বাড়ির আঙিনা। ঘরবন্দি সবাই। যান চলাচলও বন্ধ। পানি মাড়িয়ে টানা ৩ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। অনেক মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেছে। যাদের প্রয়োজন; তারাই এখানে অসহায়ের মতো পড়ে আছে।
স্থানীয় ঠিকাদার শাহিন সানা বলেন, প্রতাপনগরের ১৭টি গ্রামের ১৪টিতে পানিতে তলিয়ে আছে। অনেকে ভিটেমাটি হারিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এদের কারো খোঁজ জানি কিন্তু তারা আসে না এলাকায়। শুনেছি কেউ কৃষি কাজ, রিকশা ও মাটির কাজ করে শহর এলাকায় স্থায়ী বসবাস শুরু করেছে। প্রতাপনগর গ্রামের গোলাপ ঘোরামীর ছেলে সাদ্দাম হোসেন তার পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। কিন্তু তারা কোথায় গেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা তার হদিস রাখে না। তবে কল্যাণপুর গ্রামের আতিয়ার মোল্লার ছেলে আজিজুল মোল্লা নড়াইলের কালিয়া উপজেলায় চলে গেছেন বলে স্থানীয়রা জানালেন। বললেন, লোকমুখে শুনেছি সে কৃষি কাজ করে জীবন পরিচালনা করছে। তবে গ্রামে ফিরে আসার তার কোনো আগ্রহ নেই। সাদ্দাম ও আজিজুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সুইচ বন্ধ পাওয়া যায়।
শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বন্যতলা গ্রামের শামসুর রহমান এখন থাকছেন কপোতাক্ষের পশ্চিম পাড়ে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন নওয়াবেঁকী গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, সেই আম্পানের কাল থেকে আমরা ভিটাবাড়িতে থাকতে পারছি না। শুনি এই বাঁধ হবে, বাঁধ হবে, কিন্তু বাঁধ আর হয় না। আমাদের জমি-জায়গা যা ছিল তা সব নদীতে চলে যাচ্ছে। হয়তো আর বাড়িতে ফেরা হবে না।
কয়রার সুনীতা দাস বাঁধের ওপর তার ছাপরাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, এভাবে তো আর চলতে পারে না। আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে খালি হাতে কী করে যাবেন, চেষ্টা করছিলেন জমি বিক্রি করার কিন্তু জমিও কেউ কিনতে চাচ্ছে না। তার তিন বিঘা জমি আছে, তাতেও কেউ এক লাখ টাকা দিতে চাচ্ছে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, হয়তো সব কিছু ফেলেই এক দিন চলে যেতে হবে। কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, কাজের আশায় মানুষ এখান থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে, তারা আবার ফিরেও আসছে। এটি ঠিক সেই অর্থে এলাকাছাড়া নয়।
কয়রা ও শ্যামনগরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ফেইথ ইন অ্যাকশন। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক নৃপেন বৈদ্য প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মাইগ্রেট, অর্থাৎ স্থান ত্যাগ করছে। এই অঞ্চলের মানুষ বেশি বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ছে। মানুষ জমি-জমা, সম্পদ হারাচ্ছে। এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
সাতক্ষীরা সদর আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ঝড়, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস হলেই উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে যায়। কোনো কোনো সময় বেড়িবাঁধ টপকে পানি উঠে বসতঘর ও নদী একাকার হয়ে যায়। শেষ দুটি ঝড় আম্পান ও ইয়াসে প্রচন্ড রকমের ক্ষতি হয়েছে। এরই মধ্যে একনেকে ১ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলায় লবণাক্ততা বেশি। সুপেয় পানির সংকট প্রকট।
সাতক্ষীরার তালা-কলারোয়ার সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মোস্তফা লুৎফুল্লা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন্দ্র করে উপকূলীয় এলাকার মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন। তাদের বার বার ঘরবাড়ি ভাঙে, সুপেয় পানির অভাব, স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এই দুর্যোগের সঙ্গে যারা মানিয়ে নিতে পারছে না তারা ভিটে ছেড়ে জীবনের তাগিদে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এটা আমাদের কাম্য না।
এই এমপি আরো বলেন, এক কলসি খাবার পানি সংগ্রহ করতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ৬ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় যে বাঁধ নির্মাণ হয়েছিল তা ফসল উৎপাদনের জন্য। কারণ এটি স্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে করা হয়নি। এর পর এই বাঁধ পাউবো পরিপূর্ণ সংস্কার করেনি, যা দুঃখজনক। ফলে বার বার ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে উপকূলীয় এলাকা।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির প্রতিদিনের সংবাদকে বলেছেন, সুন্দরবনের উৎস্যমুখ মালঞ্চের শাখা খোলপেটুয়া নদীর পানির তোড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ভেঙে শ্যামনগর ও আশাশুনির দুটি ইউনিয়ন পদ্মপুকুর ও প্রতাপনগর প্লাবিত হয়েছে। সেখানকার মানুষ দুর্ভোগে আছেন। তাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাঁধ সংস্কারের কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। চলতি মাসের মধ্যে ভেঙে যাওয়া অংশটা মেরামত হয়ে যাবে বলে আশা করছি। এ ছাড়া সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করছি। তাদের ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হবে।