গাজী শাহনেওয়াজ, সাতক্ষীরা (শ্যামনগর) থেকে ফিরে

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

উপকূলীয় এলাকায় মানুষের দুর্বিষহ জীবন-১

জোয়ারে জ্বলে না চুলা

বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। কিন্তু একুশ শতকেও চাহিদা পূরণ এখনো যেন ‘সোনার হরিণ’ই থাকছে দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষের জন্য। পরিবারের সদস্যদের মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দিতেই হিমশিম কর্তাদের। বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা তাদের কাছে ‘কেতাবেই’ রয়ে যায়। এখানের নারীদের জীবন আরো সংগ্রামের। রান্নার উপকরণ গুছিয়ে তা চুলায় ওঠাতেই অপেক্ষা করতে হয় ভাটার জন্য। পানি নামলেই রান্নার কাজে নেমে পড়েন তারা। সময় পান সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা। কারণ চুলায় আগুন জ্বলে না জোয়ারে। এই গল্প সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বন্যাতোলা গ্রামের বাসিন্দাদের।

এই গ্রামেরই নুরজাহান বেগম (৫০)। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে গত বছরই ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হন তিনি। সময় গড়ালেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি অতি জলোচ্ছ্বাসেও উপকূল ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। আর দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয় ঘরবাড়ি, ফসলসহ আবাদি জমি। সবশেষ যশের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রতিনিয়ত পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। পানির সঙ্গে লড়াই করে নিদারুণ কষ্টে বেঁচে আছে নুরজাহানের মতো হাজারো মানুষ। অভিযোগ আছে, বাঁধের সংস্কার হয়। কিন্তু টেকে না বাঁধ। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে মাসের পর মাস সংগ্রাম করে বেঁচে আছে উপকূলীয় বাসিন্দারা।

সম্প্রতি উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আমিরোন বিবি নামে (৫৫) একজন বয়স্ক নারী বেড়িবাঁধের ওপর নারিকেলের ডোগা টুকরো টুকরো করে আলাদা করছেন। কথা হয় ওই নারীর সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই অনেক দিনের জমানো অভিযোগ বলতে থাকেন। কথার মাঝে বেরিয়ে আসে কষ্টের কথা। বললেন, রাত-দিনে দুবার জোয়ার-ভাটা হয়। রাতে পানি নামলেও রান্নার উপায় থাকে না। তবে দিনের বেলায় জোয়ারের পানি নামলেই তড়িঘড়ি নেমে পড়েন রান্নার কাজে। একবারের রান্নায় চলে তিনবেলা। অনেক সময় ভাটায়ও রান্নার কাজ শেষ করতে পারেন না তারা। সেদিন কলা-পাউরুটির ওপর নির্ভর করতে হয় তাদের। সেটাও জোগাড় করতে যেতে হয় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে।

নুরজাহান বেগম (৪০) নামে আরেক নারী বলেন, ভাটার জন্য অপেক্ষার সঙ্গে জ্বালানির সংকটও প্রকট। নদীর পানিতে ভেসে আসা কাঠের টুকরো কুড়িয়ে স্তূপ করে রাখা হয়। এখন শরৎকাল। দেখা যায়, জ্বালানি শুকানোর আগেই সেগুলো বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিয়েছে। অথবা বেড়িবাঁধে রাখা জ্বালানিগুলো অতিবৃষ্টিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এ কারণে অনেক সময় ভাটায় পানি নামলেও জ্বালানি সংকটে চুলায় আগুন জ্বলে না। তখন উপোস থেকে পার করতে হয় দিন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এদের থেকে পালিয়ে বেড়ান। কাছে গেলেই শুনতে হয় নানা অভিযোগ-অনুযোগ। এ কারণে দুর্যোগ ও পানিতে প্লাবিত এলাকায় কম ভিড়তে চান জনপ্রতিনিধিরা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের দাবি একটাই তারা ত্রাণ চান না; চান টেকসই বেড়িবাঁধ। কারণ একটা দুর্যোগ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আরেকটি দুর্যোগ এসে কেড়ে নেয় তাদের বসতভিটা ও স্বপ্ন। সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলোর নদীগর্ভে ঘরবাড়ি বিলীন হতে হতেই এখন নিঃস্ব-অসহায়। আর দুর্বল বেড়িবাঁধে সর্বস্ব হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসএম আতাউল হক দোলন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত আম্পানসহ বড় বড় পাঁচটি দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি। প্রতিনিয়ত জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যে পদ্মপুকুরের বন্যাতোলা এলাকায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় জাইকার অর্থায়নে বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়েছে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে। চলতি মাসের শেষ দিকে কাজ শুরু হতে পারে।’

এসএম আতাউল হক বলেন, ‘সেখানের মানুষের দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করছি। আমরাও সমব্যথী। কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগে এসব বৃহৎ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ডিপিপি করা হয়েছে। আশা করি, অচিরেই এসব উপকূলীয় এলাকার মানুষ সুখবর পাবে।’ পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম আতাউর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘পানিবন্দি এসব মানুষের দুর্যোগে যা যা করার সবই করেছি। জাইকার টেন্ডারটি ঘূর্ণিঝড় যশের আগে হয়েছিল। জাইকা ও পাউবোর লোকজন এই ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ পর্যবেক্ষণ করেছে। দু-এক দিনের মধ্যে বাঁধ বাঁধার কাজ শুরু হবে বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চুলা,উপকূলীয় এলাকা,জোয়ার,বন্যাতোলা গ্রাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close