মো. সবুজ হোসেন, নওগাঁ

  ০৮ মার্চ, ২০২১

আত্মপ্রত্যয়ী মেহের নিগার এখন অনেকের জন্য অনুকরণীয়

কাঁধে পড়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব। সাত বছর আগে স্বামী চলে যান না ফেরার দেশে। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে অথৈ সমুদ্রে একলা নাবিক তিনি। শশুর বাড়িতে ঠাঁই হয় না। আত্মসম্মানের কথা ভেবে বাবার বাড়িতেও যেতে নারাজ। স্বামীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাড় করে এখন সাবলম্বী।

২০১৯ সালে হজ্ব করেছেন। বর্তমানে তার দোকানে ১০জন কর্মচারী রয়েছে। নওগাঁ শহরের প্রাণকেন্দ্র বসাক সপিং কমপ্লেক্স “রাশেদ ব্যাগ হাউজ” নামে তার দোকানটি।

মেহের নিগার সুইটি(৩৫) আজকের অবস্থানে আসার গল্পটা রীতিমতো এভারেস্ট জয়ের মতো। ১৭ বয়সে একদিন স্কুল থেকে এসে নিজের বিয়ের কথা শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন সুইটি। কোনো কিছু বলার বা মতামত দেয়ার ফুরসতটুকুও সেদিন দেয়া হয়নি তাকে।

যে বয়সে এ গ্রাম ওগ্রামে বেণি দুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা, আর সেই বয়সে বসতে হয়েছে বিয়ের পিড়িতে। অপ্রত্যাশিতভাবেই বউ সেজে যেতে হয় শশুর বাড়িতে। গল্পটি নওগাঁ সদর উপজেলার পার- নওগাঁর মেহের নিগার সুইটির।

২০০০সালে পার নওগাঁর মজিবর রহমান খানের ছোট ছেলে রাশেদ রহমান খানের সাথে সদর উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের ১৭ বছরের মেয়ে মেহের নিগার সুইটির বিয়ে হয়। বিয়ের ১৪ বছরের মাথায় স্বামী চলে যান না ফেরার দেশে। সুইটির কাধেঁ পড়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অথৈ সমুদ্রে একলা নাবিক তিনি।

স্বামীর আকস্মিক অকাল মৃত্যুর পর অভাব আর নিঃসঙ্গতা তাকে সব সময় তাড়া করছিলো। এক সময় পরিকল্পনা করেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। যেই ভাবনা সেই কাজ। আত্মপ্রত্যয়ী সুইটি শুরু করেন স্বপ্নের ফুল ফোটাতে। সে জন্য তিনি নওগাঁ শহরের পুরাতন সোনালী ব্যাংক রোডে বসাক শপিং কমপ্লেক্স্রে স্বামীর রেখে নামে রেখে যাওয়া রাশেদ ব্যাগ হাউজ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পূণরায় যাত্রা শুরু করেন। অনেক চড়াই উত্তরায় পেরিয়ে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি সাফল্যের দ্বার প্রান্তে।

বর্তমানে সুইটির প্রতিষ্ঠানে ৯জন কর্মচারী কাজ করছে যার কারনে তাদেরও কর্মস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শরিফুল ইসলাম ও সাব্বির হোসেন জানান, সুইটি আপার এই প্রতিষ্টানে আমরা প্রায় ৬বছর যাবৎ কর্মরত আছি। আগে বেকার ছিলাম এখানে কাজ করে যে বেতন পাই তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। তিনি অনেক ভালো মনের মানুষ আমাদের সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করেন। বিভিন্ন উৎসবের সময় আমাদের বাড়তি সন্মানীও দিয়ে থাকেন।

প্রতিষ্ঠানে ব্যাগ কিনতে আসা বিজিবি ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দা মুনমুন চৌধুরী ও জান্নাতুন নাঈম জানান, সুইটি আপার দোকানে ব্যাগ কিনতে এসেছি, প্রয়োজন হলে এখানেই কিনতে আসি। আপা খুব ভালো মানুষ যতদূর জানি স্বামী মারা যাবার পর অনেক কষ্ট করে ব্যবসাটাকে দ্বার করেছেন। সুইটি আপা অনেক নারীর জন্য অনুকরণীয়, যাকে দেখে অনেক অসহায় নারীরা উৎসাহিত হবে।

“নারী হিসেবে সুইটির ব্যবসা করার বিষয়টি সমাজ ও পরিবার খুব সহজ ভাবে মেনে নেয়নি। তাও আবার মফস্বল এর মত ছোট জেলা শহরে। পরিবার থেকেও সে সময় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। স্বামী মারা যাওয়ার সময় তেমন কোন অর্থও রেখে যাননি ব্যবসাটিকে দাঁড় করানোর জন্য। তাই অর্থই সে সময় বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।” নিজের জমানো কিছু টাকা ও গহনা বিক্রি করে শুরু করেন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নযাত্রা। সে সময় দৃঢ় মনোবল ও সাহসই ছিল তার বড় সঙ্গী।

সুইটির বর্তমান অবস্থা জানতে চাওয়া হলে শোনা গেল তৃপ্ত কন্ঠ। তিনি বলেন, “বর্তমান আমার এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৯জন কর্মচারী রয়েছে। এখানে থেকে পাশা পাশি উপজেলার বিভিন্ন শোরুমে পাইকারা পণ্য কিনে নিয়ে যায় এবং খুচরাও বিক্রি করে থাকি। এছাড়া আমার দোকানের পণ্যের এখন চাহিদা অনেক বেশি। তবে এ ব্যবসাকে আরো বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।” বিভিন্ন ধরনের ব্যাগের পাশাপাশি ছাতা, ম্যানিব্যাগ, বেল্ট, নারীদের পার্সসহ কয়েক ধরনের পণ্য রয়েছে।

শুরুর দিকটা কেমন ছিল জানতে চাইলে মেহের নিগার সুইটি বলেন, প্রতিটি কাজেই নানা ধরনের বাঁধা আসে। তাছাড়া আমি একজন নারী। গত ৭বছর আগে আমার স্বামী রাশেদ রহমান খান স্টোক করে মারা যায়। এর পর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে খুব অসহায় হয়ে পড়ি। নিজে বিয়ে করিনি শুধু দুই সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে। তাদের উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত জীবন উপহার দিতে নেমে পড়ি জীবন যুদ্ধে।

স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়ি ছাড়া তেমন কিছুই নেই যা দিয়ে সংসার চালাবো। এমন অবস্থায় হঠ্যাৎ করে মাথায় আসলো স্বামীর ব্যাগের ব্যবসার কথা। স্বামী মারা যাবার পর তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় ১বছর বন্ধ ছিল। শুধু ব্যবসার দোকান ঘরটি পজিশন নেয়া ছিল। তার পর সেই দোকানে আমার জমানো কিছু টাকা ও গহনা বিক্রি করে কিছু টাকা দিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করি।

সুইটি বলেন, ব্যবসার শুরুর দিকে প্রতিবেশি ও পরিবারের লোকজন অনেকে হেয় করে কথা বলেছে। স্বামী নাই নতুন করে বিয়ে না করে ব্যবসা করছি দোকানে বসছি প্রতিদিন এগুলো নিয়ে চারপাশের সবাই কেমন জানি অন্য চোখে দেখতো। এগুলো ভাবতে আমার খুবই খারাপ লাগতো। সেই সময় গুলোতে উৎসাহ বা শান্তনা দেয়ার মত কাউকে পাশে পাইনি ঠিকমত।

কত দিন, কত রাত নিরবে কেঁদেছি কতটা অসহায় বোধ করেছি নিজেকে তা বলে বুঝাতে পারবো না। তবে আমার আশা-ভরসা ও নিঃসঙ্গ জীবনে দুই সন্তানই শূন্য জীবনে পরম সুখের স্থল। নিজের ব্যক্তি সুখকে বির্সজন দিয়ে সন্তানদের ভবিষৎ গড়তে সেই, সাথে কারো কাছে যেন সাহায্যের হাত পাততে না হয় সেজন্য এরকজন নারী হয়েও কোন বাঁধাকে বাঁধা না মনে করে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বর্তমান একটি সাফল্যের দ্বাড় প্রান্তে নিয়ে এসেছি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে।

বর্তমানে পরিবারের যারা আছে সেই আত্মীয় স্বজনরা নানাভাবে উৎসাহ দিয়ে থাকে। আমার বড় মেয়ে রেজওয়ানা রহমান রিশা নওগাঁ সরকারি কলেজে ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ছে এবং ছেলে গোলাম মোস্তফা রিফাত নওগাঁ জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেনিতে পড়াশোনা করছে। সবমিলে বতর্মানে সন্তানদের নিয়ে ভালোই আছি। শুধু একটাই অপূর্ণতা প্রিয় স্বামী নাই। আল্লাহ যেন আমার স্বামীটাকে জান্নাতবাসী করেন সেই দোয়া করি সব সময়।

বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পেছনে সব চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থ ও দিক নির্দেশনা ও পারিবাকি সহযোগিতার অভাব এমনটাই মনে করে সুইটি আরও জানান, আসলে ব্যবসায় নামতে হলে বা উদ্যোগতা হতে গেলে কোন মাধ্যম থেকে পুঁজি ব্যবস্থা করা যাবে, সেটাই জানেন না অনেক নারী।

বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিলে টানতে হয় চড়া সুদ। অন্যদিকে সরকারিভাবে ঋণ সেবার তথ্য ভালোভাবে সকলের কাছে পৌঁছানোর উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি উল্লেখ করেন, শুধু অর্থের জোগান হলেই হবে না। পণ্যের সঠিক বাজার জাতের পদ্ধতিও জানতে হবে।

পিডিএসও/এসএম শামীম

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আত্মপ্রত্যয়ী,মেহের নিগার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close