আগামী ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় ধাপে নওগাঁ পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচারে পিছিয়ে নেই কোন প্রার্থী। পৌরসভা জুড়ে ব্যানার, পোস্টার ও লিফলেটের সমারোহ।

প্রচণ্ড শীত ও করোনার প্রভাবকে পিছনে ফেলে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা চষে বেড়াচ্ছেন ভোটারের বাড়ি বাড়ি। পাড়া-মহল্লা, চায়ের স্টলে আড্ডাসহ সবখানে এখন নির্বাচনি আলাপ। পৌর বাসীর মুখে-মুখে এখন নির্বাচনই যেন এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়।

প্রার্থীরা ভোটারদের সঙ্গে করছেন কুশল বিনিময়, উঠান বৈঠক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদের সঙ্গে কথা বলছেন। সেই সাথে ভোটারদের দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। নিজেদের তুলে ধরতে লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার করছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিজেদের জানান দিচ্ছেন প্রার্থীরা। নওগাঁ পৌরসভার উন্নয়ন করতে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় যেন দম ফেলার সময় নেই কোন প্রার্থীর।

নওগাঁ পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে মোট ৫ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতিক লড়ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্মল কৃষ্ণ সাহা, বিএনপি থেকে ধানের শীষের প্রতিক পেয়ে নির্বাচনে লড়ছেন বর্তমান পৌরসভার নজমুল হক সনি, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন নওগাঁ চেম্বার অব কর্মাস এন্ড এন্ডাষ্ট্রির সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল, জাতীয় পাটি থেকে নাঙ্গল প্রতিকে ইফতারুল ইসলাম (বকুল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে হাত পাখার প্রতিকে লড়ছেন আতিকুর রহমান।

নির্বাচনে মেয়র পদে মোট ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করলেও লড়াই হবে মূলত ত্রিমুখী। মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী নির্মল কৃষ্ণ সাহা, বিএনপি মনোনীত প্রার্থী (বর্তমান মেয়র) নজমুল হক সনি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী (নারিকেল গাছ প্রতীক) নওগাঁ চেম্বার অব কর্মাস এন্ড এন্ডাষ্ট্রির সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল।

১৯৬৩ সালে নওগাঁ পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে এটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভার মর্যাদা পায়। ১৯৮৭ সালে মূল শহরের সঙ্গে আরও শতাধিক মহল্লাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সর্বশেষ ২০১৫সালে পৌর নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়ে ধানের শীষ প্রতীকে মেয়র নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করেছেন নজমুল হক সনি। নির্বাচনে ৩৪ হাজার ৮৮৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়ে মেয়র পদে দ্বিতীয় বারের মত বহাল থাকেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দেওয়ান ছেকার আহম্মেদ শিষাণ ২২’শ ভোটে পরাজিত হন।

নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নজমুল হক সনি বলেন, আমি জনগনের ভোটে পর-পর দু”বার নির্বাচিত পৌর মেয়র। পৌরবাসীর দোয়া ও সমর্থন এর কারনেই তা সম্বব হয়েছে।

আসন্ন পৌর নির্বাচনে পূনরায় বিজয়ী হওয়ার যে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন? কি কারণে পৌরবাসী ভোট দিবেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৌরবাসীকে আধুনিক ও মানসম্মত পৌরসভা উপহার দিতে মহা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাস্তা নির্মাণ, রাস্তা প্রসস্থ করণ, ড্রেন নির্মান কাজকে তরান্বিত করেছি।

নওগাঁ পৌরসভায় ২টির বেশি আরডিসি ছিলনা আমি বর্তমানে সকল রাস্তার পাশাপাশি আরডিসি ড্রেন নির্মানের ব্যবস্থা করেছি। পৌর এলাকা আলোকিত করতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন এর ব্যবস্থা করেছি। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এখন পৌরবাসীর দোড়গরায়। আগামী তিন মাসের মধ্যে পুরো পৌরবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ সম্ভব হবে বলে মনে করছি।

শিক্ষার্থীদের সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে ফুটপাত নির্মাণ করেছি। এছাড়া শহরের মুক্তি মোড়ে ফুটওভার ব্রিজ নির্মান প্রক্রিয়াধীন আছে। সিডিসি প্রকল্পের মাধ্যমে ঘন বসতীপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্টির দরিদ্র এলাকায় সকল অলিগলি পাকা করণ, ড্রেন নির্মাণ, পাকা পায়খানা নির্মাণ নিশ্চিত করেছি।

এছাড়া এ প্রকল্পের বাস্তবায়নে স্থানীয় মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পের জরিপে নওগাঁ পেরৈসভা প্রথম স্থান অধিকার করায় বিদেশি ইংল্যান্ড, চীন, ও জাপান সফরের হয়েছে যা আমাদের অর্জন। গরীব অসহায় জনগোষ্ঠীর মাঝে যথাযথভাবে ভিজিএফ চাল, বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, গর্ভকালীন ভাতা,শিশু খাদ্য বিতরণ নিশ্চিত করেছি। শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা অব্যহত আছে।

তাছাড়া ইতোমধ্যে ময়লা আর্বজনা থেকে কমপোষ্ট সার তৈরি প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যার কার্যক্রম আগামী দুই মাসের মধ্যে শুরু হবে বলে আশা করছি। আমি মনে করি পৌরসভায় যে সব কাজ করেছি এগুলোর কাজের জন্য প্রিয় পৌরবাসী আমাকে পূণরায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন। আমি যদি আবারও জয়ী হই তবে নওগাঁ পৌরসভাকে সার্বিকভাবে একটি উন্নত পৌরসভা হিসেবে গড়ে তুলবো সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আমি আশা করছি একটি অবাদ,সুষ্ট ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে নির্বাচন কমিশন সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন নওগাঁ চেম্বার অব কর্মাস এন্ড এন্ডাষ্ট্রির সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল। নির্বাচন নিয়ে তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, পৌরসভা নির্বাচন করবো বলে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে আসছিলাম। মনোনয়ন উত্তোলনের পর থেকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয়েছি।

এরপর যাচাই বাছাইয়ে মনোনয়ন বাতিল করা হলেও পরে হাইকোর্ট থেকে বৈধতা পাই। ফলে মাঠে নামতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারনায় বিভিন্ন ভাবে বাঁধাগ্রস্থ হতে হচ্ছে। ভোটারদের কাছে আমার প্রতাশ্যা প্রতীক না; ব্যক্তি দেখে ভোট দিবেন। আমি নির্বাচিত হলে, সবার আগে প্রমাণ করবো আমি এই পৌরবাসির লোক। আমার অফিস হবে আপনাদের অফিস। আর পৌর ভবন হবে আপনাদের বাড়ি।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কেন পৌরবাসী ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তি উদ্যোগে শহরের কুমাইগাড়ীতে প্রয়াত জননেতা আব্দুল জলিল নামে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন,পৌর একালায় দুটি মসজিদ নিমাণ, নওগাঁ সদর হাসপালে রক্তের গ্রুপ পরিক্ষার মেশিন প্রদান, একটি ময়লা ফেলার গাড়ি প্রদান, অস্বচ্ছল ও দুস্থ মহিলাদের স্বাবলম্বী করার লক্ষে পৌর এবং নওগাঁ সদর উপজেলার ৫০০জনকে সেলাই মেশিন প্রদান, নওগাঁ পৌর এলাকার বিভিন্ন স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ ও মন্দিরের উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন সময় অনুদান প্রদান, নওগাঁ কেডি ও বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে অভিবাবক ছাউনি নির্মান। শহর পরিচ্ছনতার লক্ষে শহরে ৫টি ড্রাস্টবিন প্রদান, জেলা ক্রীরা সংস্থার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনকে ক্রীরা সামগ্রী ও অনুদান প্রদান, দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, আওয়ামী লীগের নির্মানে সয়েল টেষ্ট বাবদ অনুদান, বিগত ৮বছর যাবত জিপিএ ৫প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংর্বধনা ও বঙ্গবন্ধুর আত্নজীবনী বিতরণ সহ নানা সামাজিক সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছি যা পৌরবাসী অবগত আছেন। আমার সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রিয় ভোটাররা আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন বলে আশাবাদী।

এদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্মল কৃষ্ণ সাহা শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী এবং উত্তরবঙ্গের মুক্তিযোদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত জননেতা আব্দুল জলিলের আদর্শে গড়া এই নেতা মেয়র প্রার্থী হওয়ায় সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সাড়া জেগেছে।

এদিকে প্রবীণ এই নেতাকে মেয়র করার লক্ষে প্রতিদিন নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে গিয়ে গণসংযোগ, পথসভা, মতবিনিময় শুরু করছেন। পৌর নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষদের কাছে।

মেয়র প্রার্থী নির্মল কৃষ্ণ সাহা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত জননেতা আব্দুল জলিল নওগাঁ পৌরসভাকে একটি আধুনিক পৌরসভায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তির বিধানে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। তার স্বপ্নও মাটি হয়ে গেছে। নওগাঁ পৌরসভা প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হওয়ার পরেও পৌরসভার অধিকাংশ রাস্তা চলাচলের অযোগ্য বিশেষ করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা একেবারে অচল।

এর অন্যতম কারন নওগাঁর পৌর মেয়র অন্য মতাদর্শের হওয়ার ফলে সহযোগিতার অভাব। এই প্রথম দল থেকে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। তাই নওগাঁ পৌরবাসী নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জননেতা আব্দুল জলিলের স্বপ্ন আধুনিক পৌরসভা গঠনে সহায়তা করবেন, এবং দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

তিনি আরও বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের বিকল্প নেই। তার প্রমাণ দেশবাসী পেয়েছে। যদি আমি জয়ী হই তবে নওগাঁ পৌরসভাকে মাদক, সান্ত্রাসমুক্ত ও আধুনিক ডিজিটাল মডেল পৌরসভা হিসেবে পৌরবাসীকে উপহার দিব।

অন্যদিকে পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে পুরো পৌর এলাকায় জুড়ে এখন উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এখন ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদানের জন্য অপেক্ষা করছেন। সব কিছু মিলে নওগাঁ শহরের সবখানে এখন মূল আলোচ্য বিষয় নওগাঁ পৌরসভা নির্বাচন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা আগামী ৩০তারিখের নির্বাচনে কে হবেন পৌর পিতা।

উল্লেখ্য, ১৯৬৩ সালে নওগাঁ পৌরসভা প্রতিষ্ঠালাভ করে। নওগাঁ সদর উপজেলার প্রান কেন্দ্রে ছোট যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। পৌরসভার আয়তন ৩৮.৩৬ বর্গ কিলোমিটার (মাষ্টার প্ল্যান অনুসারে)।

নওগাঁ পৌরসভায় মোট ৯টি ওয়ার্ড ও ৩টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড। নির্বাচনে মোট ৪১টি কেন্দ্রে ৩৩২টি বুথে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নওগাঁ পৌরসভার মোট ভোটার সংখ্যা ১,১৬,২৪০জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫৭,২৩৯জন এবং নারী ভোটার ৫৯ হাজার ১জন।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান জানান, নওগাঁ পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল প্রস্তিুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। একটি অবাধ ও সুষ্ট নির্বাচনের লক্ষে এইমধ্যে প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে।

পিডিএসও/এসএম শামীম