বিশেষ প্রতিবেদক, রাজশাহী

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

রাসিকের ১৬ ফ্লাডলাইট স্থাপনে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ

বাজারমূল্যের চেয়ে ঠিকাদারকে দেয়া হয়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকা

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) ১৬টি ফ্লাডলাইট স্থাপনে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফ্লাডলাইট স্থাপন এবং সহায়ক উপকরণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোয়া দুই কোটি টাকা হলেও রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ৯ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করেছে। এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে বাজারমূল্যের চেয়ে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪৩ টাকার বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

রাসিকের ১৬ মিটার উচ্চতার হাই মাস্ট পোল টেন্ডার নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাজ পাইয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটির এস্টিমেট অনুযায়ী টেন্ডার আহ্বান করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অনুযায়ী পুরো প্যাকেজটির মোট মূল্য দাঁড়ায় ২ কোটি ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৭৩৪ টাকা। অথচ, প্রতিটি আইটেমের দাম তিন থেকে চার গুণ বেশি ধরে ৯ কোটি ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। আর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একটি মাত্র দরপত্রে পুরো কাজটি হ্যারোকে দিয়ে করানো হয়।

এ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যোগ করলে একেকটি পোল বা ফ্লাডলাইটের খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫১৫ টাকা। কিন্তু রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিটি খুঁটির জন্য হ্যারোকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেছে। ফলে এ কাজে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৫ টাকা করে প্রতিটি খুঁটিতে অতিরিক্ত বিল দেয়া হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, টেন্ডারের শর্তানুযায়ী পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও হ্যারোকে কাজটি দেয় রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদেশ থেকে আমদানি করা এসব বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির শিপমেন্ট ডকুমেন্ট, এলসি, বিল অব ল্যান্ডিং, শুল্ক, কর ও ভ্যাট পরিশোধ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্রও দাখিল করেনি হ্যারো। বিল পরিশোধেও এসব জরুরি বিষয় উপেক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া সরবরাহ ও স্থাপন করা সরঞ্জামাদির মান যাচাইয়ে টেন্ডারের শর্তানুযায়ী বুয়েট থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করানো হয়নি।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, চীনের তৈরি ২০ থেকে ২৫ মিটার উচ্চতার একটি হাই মাস্ট বা খুঁটির সর্বোচ্চ দাম তিন হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৬১ হাজার টাকা হয়। এর সঙ্গে শতকরা ৬১ ভাগ হিসাবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ টাকা আমদানি শুল্ক, ক্রয়মূল্যের ওপর শতকরা ২০ ভাগ হিসাবে ৪৩ হাজার ২০০ টাকা ভ্যাট ও আয়কর, বন্দর থেকে দেশের যে কোনো স্থানে সর্বোচ্চ পরিবহন ও স্থাপন ব্যয় ৭০ হাজার টাকা এবং প্রচলিত নিয়মে শতকরা ১৫ ভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যোগ করলে একেকটি বা ফ্লাডলাইটের খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫১৫ টাকা। কিন্তু রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিটি খুঁটির জন্য হ্যারোকে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৫ টাকা করে অতিরিক্ত বিল হিসাবে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেছে।

জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন মোড়ে হাইভোল্টেজ এলইডিসহ ১৬টি হাই মাস্ট বা ফ্লাডলাইট স্থাপনে ৯ কোটি ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ টাকার টেন্ডার ডাকে রাসিক। এর প্রেক্ষিতে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর হ্যারো ৯ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৭ টাকা ৭০ পয়সা দর দাখিল করে। ফ্লাডলাইটে ব্যবহৃত ২০০ ওয়াট ক্ষমতার ৩২০টি এলইডি লাইটের প্রতিটির বাজারমূল্য ১৫ হাজার ৮৭৩ টাকা হলেও টেন্ডারে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা দর হিসাব করে মোট ২ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়। যার প্রেক্ষিতে ২০০ ওয়াটের প্রতিটি এলইডির দাম ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা করে মোট ২ কোটি ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ বাজারমূল্যে ৩২০টি এলইডির মোট দাম পড়ে ৫০ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬০ টাকা। এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৪০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

ফ্লাডলাইটে সংযোজিত ২০০টি ২৫০ ওয়াট ক্ষমতার এলইডির প্রতিটির বাজারমূল্য ১৯ হাজার ৩০৯ টাকা হলেও টেন্ডারে প্রতিটির মূল্য ৭৫ হাজার টাকা হিসাবে মোট ব্যয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়। চীনা আরওএইচএস কোম্পানির তৈরি ২০০টি এলইডির মোট বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৮০৪ টাকা হলেও হ্যারোকে অতিরিক্ত ১ কোটি ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকাসহ এই খাতে মোট বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।

আর ৬৩ এএমপি অটো লজিক কন্ট্রোলারের এক ইউনিটের বাজারমূল্য ৩৬ হাজার টাকা হলেও ঠিকাদারকে ১৬টি এএমপি কন্ট্রোলারের প্রতি এককের মূল্য ৭২ হাজার টাকা হিসাবে মোট ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকার বিল দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে হ্যারোকে অতিরিক্ত ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। একইভাবে ১ হাজার ২৪০ মিটার ক্যাবল সরবরাহেও ঠিকাদারকে ৩৭ হাজার ২০০ টাকা বেশি বিল দিয়েছে রাসিক।

এ বিষয়ে রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেয়াজত হোসেন বলেন, নগরীতে স্থাপিত ১৬টি হাই মাস্ট বা ফ্লাডলাইট ও সরঞ্জামাদি অতি উচ্চমানের বলেই দাম কয়েকগুণ বেশি ধরা হয়েছে। আর একবারের টেন্ডারে অংশ নেয়া একমাত্র ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাজ দেয়ায় পিপিআর’র শর্ত লঙ্ঘন বিষয়ে বলেন, টেন্ডারে অন্য প্রতিষ্ঠান অংশ না নেয়ায় হ্যারোকে কাজটি দেয়া হয়েছে বিধায় একাধিকবার টেন্ডার আহ্বান করার প্রয়োজন হয়নি। এ সময় হ্যারোর অভিজ্ঞতার সনদ না থাকা ও পণ্যের মান পরীক্ষার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেন নি।

হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল হুদা টিটো দাবি করেন, টেন্ডারের সব শর্ত পূরণ করেই কাজটি তিনি পেয়েছেন। অতিরিক্ত পণ্যমূল্য নেয়া হয়নি। বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি সব পণ্য সরবরাহ ও স্থাপন করেছেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাসিক,ফ্লাড লাইট,দুর্নীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close