বালিয়াড়ির বুকে নূহের প্লাবনের স্মৃতি?
১০ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তৈরি হয়েছে ফসিলে পরিণত হওয়া এসব বালিয়াড়ি। জলবায়ু সংকট কীভাবে বিশ্বকে নতুন চেহারা দিতে পারে, তার একটি ধারণা সেখানে মিলতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে আবু ধাবি শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্বের শূন্য মরুর দিকে গাড়িতে ঘণ্টাখানেক এগোলে চোখে পড়বে মানবসৃষ্ট অপ্রত্যাশিত এক ভূ-দৃশ্য। আল ওয়াতবা নামের ওই এলাকায় রয়েছে মরুদ্যানের মত অপরূপ এক জলাধার। বলা হয়, একটি পানি শোধনাগার থেকে দুর্ঘটনাবশত বেরিয়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ পানি থেকে ওই জলাভূমির সৃষ্টি। এখন সেখানে সবুজের বাড় বাড়ন্ত, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে পরিযায়ী ফ্লেমিঙ্গোরা। রাস্তার দুপাশে লাগানো সারিবদ্ধ গাছ, দিগন্তের কাছে কৃত্রিম পাহাড়ের পরাবাস্ত দৃশ্য। দানবীয় কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে সেই পাহাড়ের ধার ঘিরে রাখা।
গবেষকরা বলেছেন সেমেটিক তিন ধর্মে নূহের মহাপ্লাবনের কথা আছে। সেই কথার সঙ্গে বরফ যুগে মেরু অঞ্চলে বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে নিম্ন আরব বদ্বীপ প্লাবিত হয়েছিল। তখনই প্রলয়ংকরী স্রোত ও ঢেউয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এসব বালুর স্তূপ।
আবু ধাবির মরুর বুকে মাথা উঁচু করে থাকা এসব বালির পাহাড় দেখলে মনে হবে, উত্তাল সাগরের মাঝে যেন হঠৎ জমে স্থির হয়ে গেছে বালির ঢেউ। শূন্য মরুর বুকে শত শত বছর টিকে থাকা এসব ভূতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষার চেষ্টা হিসেবেই আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ওই এলাকা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।
ভ্রমণকারীরা যদি টিলায় চড়ে নিজেদের ছবি ফ্রেমবন্দি করতে চান, তাহলে তাদের বিশেষ বাহনে চড়ে সেখানে উঠতে হয়। সেখানে যাওয়ার পথে রয়েছে তথ্যবহুল সাইনপোস্ট, যাতে এসব বালিয়াড়ির গঠন প্রণালি নিয়ে বিজ্ঞানের মৌলিক তথ্য দেওয়া হয়েছে।
মূলত, মাটির আর্দ্রতা বালিতে ক্যালসিয়াম কার্বনেটকে শক্ত করে তোলে। আর মরুর তীব্র বাতাসের স্রোত এসব বালিয়াড়িকে দিয়েছে অদ্ভুত সব আকৃতি।
আবুধাবির খলিফা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আর্থ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক টমাস স্ট্যুবার অবশ্য মনে করেন, এসব বালির পাহাড়ের গঠনে ওইটুকু ব্যাখ্যার বাইরেও অনেক কিছু আছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে লকডাউনের বেশিরভাগ সময় ওই টিলাগুলো নিয়ে পড়াশোনা করেছেন স্ট্যুবার। সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘এটি বেশ একটি জটিল গল্প।’
আবুধাবির পরিবেশ সংস্থা বলেছে, এসব বালিয়াড়ি এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ বছরের পুরনো। তবে স্ট্যুবার বলেন, বরফ যুগ থেকে বরফ গলার যুগের ক্রিয়াচক্রের মাঝে কয়েক প্রজন্ম ধরে এসব বালিয়াড়ি তৈরি হয়েছে, যা ২ লাখ বছর থেকে সাত হাজার বছর আগে ঘটেছে।
মেরু অঞ্চলে হিমায়িত জল বাড়লে সমুদ্রপৃষ্ঠে নেমে যায়। ওই শুষ্ক সময়ে আরব উপসাগর এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া বালির স্রোত থেকে টিলাগুলো তৈরি হয় বলে মনে করেন তিনি।
মেরু এলাকায় বরফ গলতে থাকলে আর্দ্রতা বাড়তে থাকে। এই আর্দ্রতার কারণে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের বিক্রিয়ায় বালি স্থিতিশীল হয়। তাতে এক ধরনের সিমেন্টের মত তৈরি হয়, যা পরে বাতাসের কারণে ইথারিয়ালের আকৃতি নেয়।স্ট্যুবার বলেন, আরব উপসাগর আসলে একটি ছোট এবং অগভীর অববাহিকা। এর গভীরতা প্রায় ১২০ মিটার। প্রায় ২০ হাজার বছর আগে বরফ যুগের চূড়ান্ত সময়ে মেরু অঞ্চলে এত বেশি বরফ জমেছিল যে সাগর থেকে পানি শুকিয়ে যায়। এর মানে হল, উপসাগরটি তখন শুষ্ক ছিল, যা টিলাগুলো গঠনের প্রধান কারণ।
সংযুক্ত আরব আমিরাত জুড়ে থাকা এ ধরনের বালিয়াড়ি ভারত, সৌদি আরব ও বাহামাতেও পাওয়া যায়। সেসব তৈরি হতে সম্ভবত হাজার হাজার বছল লেগেছে।
আবু ধাবি সরকার এখন এসব বালির স্তূপকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেও যে ক্ষয়ের কারণে বালিয়াড়িগুলো এরকম অনন্য চেহারা পেয়েছে, সেই পথেই এক সময় সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে স্ট্যুবারের ধারণা।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে কয়েকটা বালিয়াড়িতো বিশাল আকারের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাতাসের কারণে ক্ষয়ে যেতে যেত সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। পাথরের মত মনে হলেও আপনি চেষ্টা করলে হাত দিয়ে চাপ দিয়েও সেগুলো ভেঙে ফেলতে পারবেন। এর উপাদান বেশ দুর্বল।’
এ কারণে আল ওয়াতবায় দর্শণার্থীদের টিলাগুলো থেকে কিছুটা দূরে রাখা হচ্ছে, তবে সেখান থেকেও এসব ফসিল বালিয়াড়ির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে সমস্যা হয় না।
আবু ধাবির ওই এলাকা ঘুরে দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হল সন্ধ্যার আগ মূহূর্ত। গোধুলীর আলো তখন সেইসব বালির টিলার ওপর সোনালি আভা তৈরি করে; আর আকাশ ধারণ করে বেগুনি রঙ। দর্শণার্থীদের কেন্দ্র আর স্যুভেনির স্টল থেকে বালুকাময় পথ ধরে অন্য প্রান্তে পার্কিং লটে হেঁটে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। তবে শর্টকাট রাস্তায় ফিরতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট। বালির টিলার এই অপার্থিক রূপের মাঝেই ব্যাতিক্রমী দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে দিগন্তের কাছে বসানো বিশাল লাল ও সাদা বিদ্যুতের পোল। দানবীয় ওই ধাতব কাঠামোগুলো যেন এই বালিয়াড়ির চিত্রপটকে নাটকীয় মাত্রা দেয়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে কিছু টিলা আলোকিত হয়ে ওঠে, যা এই ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়গুলো দেখার নতুন পথ করে দেয়।
আবু ধাবি শহরে কাজ করেন ডিন ডেভিস। এক দিনের ছুটি পেয়ে তিনি এ পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে এসেছেন।
সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘টিলাগুলো সত্যিই আশ্চর্যজনক। এটা ভালো যে এগুলোকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সরকার দুর্দান্ত একটা কাজ করেছে।’
পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে এসে টিলাগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছেন আশার হাফিদ। তিনি বলেন, ‘আমি গুগলে এটা দেখেছি। এখানে এসে নিজের চোখে দেখলাম।’ খলিফা ইউনিভার্সিটি থেকে স্ট্যুবার এবং তার দল প্রায়ই সেখানে যান। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। সর্বশেষ বরফ যুগে সমুদ্র স্তরের পরিবর্তন নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছে, যার উত্তর এখনও আমরা পাইনি। আরব আমিরাতের উপকূল রেখার বর্তমান ভূ-রূপ বোঝার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতে সমুদ্র-স্তরের পরিবর্তন বোঝা যাবে একই উপায়ে।’
এই গবেষকের মতে, ‘নূহের প্লাবনের কাহিনি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, সম্ভবত তারও একটি ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে এই ফসিল ডুনের রহস্যের মাঝে। আরবের মাটি থেকে উদ্ভূত প্রধান তিন ধর্মের গ্রন্থ কোরান, বাইবেল ও তাওরাতেই নূহের প্লাবনের বর্ণনা আছে। সম্ভবত বরফ যুগের শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল, তাতে আরব উপসাগর উপচে বন্যা হয়েছিল। দজলা ও ফোরাত হয়ত তখন ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়ত। যেটা এখন উপসাগর, তখন হয়ত সেটা উর্বর নিচু এলাকা ছিল, ৮ হাজার বছর আগে হয়ত সেখানে জনবসতি ছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কীভাবে বেড়ে গিয়েছিল, তারা হয়ত তা চাক্ষুষ করেছে। সম্ভবত ঐতিহাসিক কোনো প্রেক্ষাপট আটকে আছে ওইসব বালিয়াড়ির স্মৃতিতে, যার রেশ তিনটি ধর্মগ্রন্থের পংক্তিতেও এসেছে।’