স্বেচ্ছায় ‘গুম’ হতে সাহায্য করে যেসব প্রতিষ্ঠান!
যুক্তরাষ্ট্র থেকে জার্মানি, জার্মানি থেকে যুক্তরাজ্য— সারাবিশ্বেই কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা তাদের নিজের জীবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
বাড়িঘর, চাকরি-বাকরি এবং পরিবার থেকেও মাঝ রাতে তারা এমনভাবে উধাও হয়ে যান, যাতে কেউ তাদের খুঁজে বের করতে না পারেন। এর পর তারা শুরু করেন নতুন জীবন, অনেক সময় তারা আর পেছনে ফিরেও তাকান না। খবর বিবিসির।
জাপানে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে— যেগুলো মানুষকে তার পরিচিত সমাজ থেকে পালিয়ে থাকতে সাহায্য করে।
জাপানে এ ধরনের লোকজনকে অভিহিত করা হয় 'জুহাতসু' হিসেবে। এই জাপানি শব্দের অর্থ বাষ্পীভবন বা হাওয়া হয়ে যাওয়া। যেসব লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে লুকোতে চান, তাদের বোঝাতেও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
এই লোকগুলো কোথায় আছে এবং কী করছে, সেসব তারা গোপন রাখে— কখনও কখনও কয়েক বছর, এমনকি কয়েক দশকের জন্যও।
৪২ বছর বয়সি সুগিমোতো বলেন, মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ি। এর পর ছোট্ট একটি স্যুটকেস নিয়ে আমি উধাও হয়ে যাই। এক ধরনের পালিয়ে যাওয়াও বলতে পারেন। পরিচয় গোপন রাখার জন্য এখানে তার আসল নাম উল্লেখ করা হয়নি।
সুগিমোতো বলেন, যে ছোট্ট শহরে তিনি ছিলেন, তার পরিবারের কারণে সেখানে সবাই তাকে চিনত। কারণ তাদের ব্যবসা স্থানীয় লোকজনের কাছে বেশ পরিচিত ছিল। পরিবারটি আশা করছিল যে সুগিমোতো এ ব্যবসার হাল ধরবেন।
কিন্তু এই দায়িত্ব নিয়ে সুগিমোতো এমন চাপের মধ্যে পড়েন যে, তার মধ্যে মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হয় এবং তিনি খুব দ্রুত চিরদিনের জন্য ওই শহর ছেড়ে চলে যান। কোথায় যাচ্ছেন সে কথাও কাউকে বলেননি।
এভাবে হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। পরিশোধ করার মতো নয় এমন ঋণ থেকে শুরু করে প্রেমহীন বিবাহ।
তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, তারা তখন এমন কিছু কোম্পানির দ্বারস্থ হন, যারা তাদের উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করে।
এ ধরনের কাজকে বলা হয়— 'রাতে সরে যাওয়ার' সার্ভিস। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে 'জুহাতসু' হয়ে যাওয়ার গোপন প্রক্রিয়াকেই অনুমোদন করা হয়।
যেসব লোকজন উধাও হতে চান, তাদের গোপনে জীবন থেকে সরে যেতে সাহায্য করে এসব কোম্পানি। এমনকি গোপন স্থানে তাদের থাকারও ব্যবস্থা করে দেয়।
সাধারণত এভাবে চলে যাওয়ার পেছনে ইতিবাচক কারণই থাকে, যেমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, কোথাও নতুন চাকরি পাওয়া অথবা কাউকে বিয়ে করা।
জাপানের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছিল '৯০-এর দশকে। তখন পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করে এ রকম একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন শো হাতোরি।
তিনি বলেন, স্বেচ্ছায় গুম হওয়ার পেছনে খারাপ কিছু কারণও থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া, চাকরি হারানো অথবা কারও কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া।
প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন লোকজন হয়তো শুধু অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণেই তাদের সমস্যাকবলিত জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাইবে, কিন্তু খুব শিগগিরই তিনি দেখতে পান যে, এর পেছনে আরও কিছু সামাজিক কারণও রয়েছে।
তিনি বলেন, মানুষ যাতে আরেকটি দ্বিতীয় জীবন শুরু করতে পারে, সে ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যই আমরা এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছি।
সমাজবিজ্ঞানী হিরোকি নাকামোরি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লোকজনের এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি বলেন, ষাটের দশকে যারা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন, তাদের ব্যাপারেই প্রথম জুহাতসু শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।
জাপানে বিবাহবিচ্ছেদের হার খুব কম ছিল, এখনও কম। ফলে অনেকেই ডিভোর্সের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে একদিন হঠাৎ করেই তাদের স্বামী বা স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যায়।
নাকামোরি বলেন, জাপানে উধাও হয়ে যাওয়া খুব সহজ। দেশটিতে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিরা তাদের পরিচয় না দিয়েও মুক্তভাবে এটিএম থেকে অর্থ তুলতে পারেন।
এ ছাড়া পালিয়ে যাওয়া এই ব্যক্তি যদি গোপন ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো ক্যামেরাতে ধরাও পড়েন, তার পরিবারের সদস্যদের ওই ভিডিও দেখতে দেয়া হয় না।
পিডিএসও/ জিজাক